থিয়েটারের আঙিনায় কিছু কথা – পর্ব ২ – তুষার ভট্টাচার্য

স্বামীজী এবং সারা বার্নহার্ড

‘বেঁটে হালা’ – এ কার নাম?
যাঁর নাম, তাঁর বাপ-ঠাকুরদারা ছিলেন সব দশাসই চেহারার মানুষ। সেই তুলনায় ইনি ছিলেন আয়তন হিসেবে বেঁটে। তাই তাঁর ন-ঠাকুরদা গোপাল দত্ত এই নামেই ডাকতেন তাঁকে। এমনই বলে গেছেন তাঁর ছোটভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত। দত্ত পদবী দেখে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমি স্বামী বিবেকানন্দর কথা বলছি।

এই মানুষই তাঁর অগাধ জ্ঞান, পাণ্ডিত্য দিয়ে বিশ্বজয় করেছেন। সেসব কথা এখানে বলছি না। আমি একটু অন্য কথা বলতে এসেছি।
জানেনই তো, অসাধারণ গান গাইতে পারতেন তিনি। নাটকের গান তো গাইতেনই। রবীন্দ্রসংগীতের প্রতিও প্রবল ভালোবাসা ছিল তাঁর। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁকে প্রভাবিত করত। তাইতো তিনি তাঁর ‘সঙ্গীত কল্পতরু’ বইতে অন্য গানের সঙ্গে এগারটা রবীন্দ্রগান রেখেছেন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি যাত্রা ইত্যাদি দেখতে ভালবাসতেন । সেসব দেখে নকলও করতেন। তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ লিখে গেছেন,”যাত্রা ছিল ‘রাধিকার মানভঞ্জন’। আমরা দু’ভাই – বাবুদের বাড়ির ছেলে, ঘুমচোখে ঢুলতে ঢুলতে উপস্থিত হইলাম”।… যাত্রা দেখে এসে নরেন্দ্রনাথ ছাদে নাচানাচি করতেন। ‘কেষ্ট যাত্রা’ দেখে এসে সেই যাত্রার নকল করে বন্ধুদের ডাকতেন – ‘বাঁপরে কেঁষ্টরে’।
প্রসঙ্গত, সেই সময়ে অনেক যাত্রা শুরু হোত ভোরবেলা, সেটা চলত বেলা দুটো তিনটে পর্যন্ত।

সেই মানুষ আমেরিকায় গেলেন। সেখানে কী হল সেসব আপনারা জানেন।

সেখানে বিবেকানন্দ প্রচুর বক্তৃতা করেছিলেন। পাশাপাশি একটু এন্টারটেনমেন্টের দরকার ছিল তাঁর। তাই হয়ত তিনি দেখতে গেছিলেন নাটক। নাটক দেখতে তো তিনি ভালোবাসতেন। তিনি দেখতে গেলেন, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ডের নাটক।

১৮৯৬ সাল। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হল এক বুদ্ধ-নাটক। ফরাসি নাটক – নাটকের নাম ‘ইৎশীল’। নাট্যকার আরম্যাণ্ড সিলভেস্টার এবং য়ুজিন মোরাঁ। নাম ভূমিকায় অভিনয় করলেন সেকালের জগৎ বিখ্যাত ফরাসি অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ড।

“নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।
বুদ্ধ-নাটক বিসমা হোই।”

অনুবাদঃ

বজ্রাচার্য নাচেন, দেবীগান করেন।
বুদ্ধ নাটক হয় বিষম (শক্ত)।

হাজার হাজার বছর আগে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ সন্ধ্যাবেলায় মেতে উঠত ‘বুদ্ধ-নাটক’ এ। সেসব কথা লেখা আছে বৌদ্ধগান ও দোঁহায়। শুধু এই বাংলাদেশেই নয়, বাংলার বাইরে অনেক জায়গাতেই বুদ্ধের জীবনকে নিয়ে রচিত ‘বুদ্ধ-নাটক’ এর একটা ধারা আড়াই হাজার বছর ধরে চলে আসছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’, গিরিশবাবুর ‘বুদ্ধদেব চরিত’ এর উদাহরণ।

আট রাত্রি অভিনীত হয়েছিল সেই নাটক। শেষ অভিনয় হয়েছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। সেটা ছিল ম্যাটিনি শো।

এই নাটকের সম্ভবত প্রথম সন্ধ্যায় দর্শক আসনে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৬ সালে ই.টি.স্টার্ডিকে লেখা এক চিঠিতে এই ‘ইৎশীল’ নাটক সম্পর্কে উনি মন্তব্য করেছিলেন – ‘Frenchified life of Budha.’ সেই চিঠিতে তিনি নাটকের একটি দৃশ্যের বর্ণনা করেছিলেন। দৃশ্যটা ছিল এরকম — রাজনর্তকী ইৎশীল বুদ্ধকে প্রলুব্ধ করছেন। স্বামীজীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, মূল বুদ্ধজীবনী পরিবর্তিত হয়েছিল এই ফরাসি নাটকে।

বিবেকানন্দ গবেষক অসীম চৌধুরী এই নাটকের কাহিনি তাঁর বইতে প্রকাশ করেছেন। সেই কাহিনি বলার মত এত জায়গা এখানে নেই।

স্বামীজী ‘ফরাসি ধাঁচ’ বলতে কী বলতে চেয়েছিলেন, তার একটা বিশদ ব্যাখ্যা স্বামী সন্মাত্রানন্দ দিয়েছেন। এক কথায় এটা বলা যায়, তিনি বলেছেন, ফ্রান্সের যা মূল মন্ত্র — সামাজিক মুক্তি, সাম্য ও মৈত্রীকেই ( Liberte, Egalite, Fraternite) এই নাটকে ধরা হয়েছে।

হয়ত অপ্রাসঙ্গিক তবু, পুট করে একটু বলে নি — ওই তিনটে শব্দ লিবাতে, ইগালিতে, ফ্যাতানিতে আমাদের চন্দননগরে ফ্রেঞ্চ এরিয়া যেখানে শেষ ছিল, সেইখানকার একটা গেটে আজকেও দেখা যায়।

স্বামীজী তাঁর পরিব্রাজক বইতে এই ‘ইৎশীল’ নাটকের স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই স্মৃতিচারণে দেখা যায় সারা বার্নহার্ড স্বামীজীকে বলেছিলেন — “আমার বিশেষ অনুরাগ ভারতবর্ষের ওপর। তোমাদের দেশ অতি প্রাচীন, অতি সুসভ্য। এই নাটক করার আগে অনেক মিউজিয়ামে গিয়ে আমি ভারতের পুরুষ, মেয়ে, পোশাক, রাস্তা-ঘাটের সঙ্গে পরিচয় করেছি এবং সেটাই আমরা মঞ্চে এনেছি”। ওই নাটকের মঞ্চ নির্মাণে এই আন্তরিকতা স্বামীজীকে স্পর্শ করেছিল।

শ্রীমতী করবিনের বাড়িতে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬ শো-এর শেষে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সারা বার্নহার্ডের। ১৯০০ সালে প্যারিসে আবার তাঁর দেখা হয় স্বামীজির সঙ্গে। দীর্ঘ সাতদিনের অভিনয়ের পরিশ্রম এবং ক্লান্তি সরিয়ে একান্ন বছরের অভিনেত্রী দেখা করতে এসেছিলেন স্বামীজীর সঙ্গে।
ভারত ছিল সারার জীবনস্বপ্ন – সেকথা তিনি স্বামীজীকে জানিয়েছিলেন।

তাঁদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল, তার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে স্বামীজির চিঠিতে তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
স্বামীজী বলে গেছেন, “আমার পরিচিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবার এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন।… মাদাম (বার্নহার্ড) খুব সুশিক্ষিতা মহিলা এবং দর্শনশাস্ত্র অনেকটা পড়ে শেষ করেছেন।…”

সারা বার্নহার্ডকে সমস্ত ফ্রান্স বলত – ‘লা দিভিনি সারা’ – দৈবী সারা। ১৮৬৬ সালে তিনি সারা বার্নহার্ড ফ্রান্সের নজরে এলেন তাঁর অভিনয় দিয়ে। তখন তাঁর বয়স পঁচিশ। ১৮৭০ – তিনি ফ্রান্স আর প্রাশিয়ার যুদ্ধে নাটক বন্ধ রেখে আহত সৈনিকদের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। ১৮৭২, ১৮৭৭ সালে ভিক্তর হুগো’র দুটি নাটক তাঁকে বিশেষ সাফল্য এনে দেয়। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৬ তিনি তাঁর নাট্যদল নিয়ে বিশ্বভ্রমণ করলেন। সত্তর বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় তাঁর একটা পা কেটে বাদ দেওয়া হয়, তাও তিনি মঞ্চ ছাড়েননি।

১৯১৪ সালে ফ্রান্সের সর্ব্বোচ্চ সম্মান ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’ এ তিনি সম্মাণিত হন।

সারা বার্নহার্ড উঠে এসেছিলেন অপরিচয়ের অন্ধকার থেকে। তারপর তিনি তাঁর অভিনয় দিয়ে সারা পৃথিবী জয় করেছিলেন। এই অভিনেত্রী অনেক নাটক এবং নির্বাক যুগের আটটি সিনেমা এবং তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি দুটি তথ্যচিত্রে অভিনয় করেন।

ইংলণ্ডের রঙ্গমঞ্চ থেকে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। তাঁকে বলা হোত – The best Hamlet.
ভক্তরা বললেন, ফিল্মে ধরে রাখতে চাই আপনার অভিনয়। তিনি প্রথমে রাজি ছিলেন না। হ্যামলেট হয়ে তিনি ছবি করলেন। তখন আর তাঁর সেই চেহারা আর নেই, বার্ধক্য এসে গেছে, চোখ কোটরাগত, শীর্ণ শরীর। তবু অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। সে ছিল নির্বাক ছবি। তাঁর মঞ্চসফল নাটক ‘পাসিং অব দি থার্ড ফ্লোর ব্যাক’ তোলা হল ছবিতে।

অপূর্ব ছিল তাঁর কন্ঠস্বর। স্বামীজী লিখেছেন, “আর সে আশ্চর্য আওয়াজ! এরা বলে তাঁর কন্ঠে রূপার তার বাজে”।

এনস্লাইকোপিডিয়া ২০০৬ এ পাওয়া যায় ১৯০২ সালের রেকর্ডিং, যেখানে বর্ষীয়সী সারা বার্নহার্ড আবৃত্তি করেছেন ভিক্টর হুগোর কবিতা – সেখানে তাঁর সেই অপরূপ কন্ঠস্বরের সাক্ষ্য আছে।

দুটো আশ্চর্য বিষয় বলি — এক, সারা’র আত্মজীবনীতে ( Ma Double Vie) বিবেকানন্দর উল্লেখ কোথাও নেই। দুই, তাঁর এক বিচিত্র অভ্যাস ছিল। তিনি ঘুমোতেন এক শূন্য কফিন বাক্সের ভেতর।
কেন এমন বিচিত্র অভ্যাস ছিল তাঁর। অনুরাগীদের ব্যাখ্যা, ঐভাবেই নাকি সারা তাঁর নাটকের ট্র‍্যাজিক চরিত্রগুলোর কথা ভাবতেন।

২৬ মার্চ ১৯২৩ সালে তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

আমি যেন কোথাও এই অভিনেত্রীর সঙ্গে আমাদের দেশের গর্ব, অহঙ্কার সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী, অভিনেত্রী ইন্দুবালার মিল খুঁজে পাই। দুজনেরই জীবনে অনেক মিল। সেসব মিলের কথা পরে আসবে।

ইন্দুবালার কথাও বলব।

4 thoughts on “থিয়েটারের আঙিনায় কিছু কথা – পর্ব ২ – তুষার ভট্টাচার্য

  1. অমল আলো জার্নাল আজ প্রথম পড়লাম। বেশ লাগলো। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সমৃদ্ধ করবে এই জার্নাল। বিষয় বৈচিত্র্য খুবই আগ্রহোদ্দীপক। শিকড়-এর খোঁজ থেকে হাল-জমানা’র থিয়েটারি কথন সূত্রে বিন্যস্ত এই জার্নাল। পরের সংখ্যার অপেক্ষায় রইলাম।

Comments are closed.