গুহা
ফ্ল্যাশব্যাক
অনেক অনেক পেছনে চলে যাচ্ছি এবার। সেই প্রাচীন ভারতে। খ্রীষ্টের জন্মেরও আগের কথা।
না, না। ভরত মুনির কথা বলব না। ওঁর কথা তো আপনারা জানেন। এটা অন্য কথা। পেয়ে গেলাম এক জায়গায় কিছু ইন্টারেস্টিং খবর। সেটাই আপনাদের কাছে নিয়ে এসেছি। এসবও হয়ত আপনারা অনেকেই জানেন। তবু…
অজন্তা-ইলোরা তো আপনারা অনেকেই গেছেন, দেখেছেন, দেখে স্তম্ভিত হয়েছেন… ওখান থেকে পুস্তিকা কিনেছেন। জেনেছেন এই গুহাগুলো আবিষ্কার করেছিলেন ব্রিটিশরা।
আমার আজকের লেখাতেও গুহা আর ব্রিটিশ।
এমনিতে ব্রিটিশরা বেশ ত্যাঁদোড় ছিল, অনেক লুঠেপুটে নিয়ে গেছে আমাদের দেশ থেকে, অনেক অত্যাচার করেছে, আবার কিছু দিয়েও গেছে। এই অজন্তা-ইলোরা, প্রাচীন নাট্যশালা ইত্যাদি অনেককিছু আবিষ্কারও করে গেছে।
আচ্ছা ওঁরা কি নিজেদের চেষ্টাতেই এসব আবিষ্কার করেছে? স্থানীয় মানুষজনদের কোনোই সাহায্য কি নেয়নি তারা? আমার তো মনে হয়, একদম নিয়েছে। অনেক সময়েই শিকার, কোথায় কী মিনারেল পাওয়া যায় এসব ধান্দায় ওরা এদিকসেদিক ঘুরত। তখন নিশ্চয়ই স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞেস করত, “হ্যাঁ রে এদিকে বাঘ-সিংহ কিছু দেখতে পাস”? ব্যস তারা হয়ত সেরকম কোনো জায়গা দেখাতে নিয়ে গেল, আর সেখানে গিয়ে ওরা হয়ত অজন্তার মত গুহা দেখল। যে গুহার কোন মূল্যই নেই স্থানীয় মানুষের কাছে। ব্যাস অজন্তা ইত্যাদিতে আবিষ্কারে নাম হয়ে গেল ওই ব্রিটিশের। তাছাড়া ওরা কালোকুলো লোক, ওদের নাম কেন হবে এই আবিষ্কারে! যা ভাগ।
এই দেখুন না জলজ্যান্ত প্রমাণ – হিলারী কি একা উঠেছিলেন এভারেস্টে? নাকি এভারেস্টের উচ্চতা একাই আবিষ্কার করেছিলেন মিঃ এভারেস্ট?
ট্রেলার তো হল। এবার মেন পিকচারে যাই।
নাটক করার জন্যে তো একটা মঞ্চ লাগে, হল লাগে.. খোলা জায়গাতে নাটক হয় না এমন নয়, রাস্তাতেও তো হয় নাটক। হয় না? যাকগে, বাদ দিন। অত কচকচিতে গিয়ে কাজ নেই। কথায় কথা বাড়ে। আপনি একটা বলবেন, আমি একটা বলব, তর্ক বেড়েই যাবে। শেষ পর্যন্ত কিছুরই সমাধান হবে না। আমরা আমাদের ধ্যান ধারণা নিয়ে যেখানে ছিলাম সেখানেই থাকব। খুব পাজী আমরা।
তার থেকে বরং ওই ব্রিটিশ আর গুহার গল্পে যাওয়া যাক।
মানুষ যতই খাক-পরুক, জীবনে এন্টারটেনমেন্ট কিন্তু একটা ব্যাপার। এটা চাইই চাই। আমাদের অনেক আগের বাপ, কাকা, দাদারাও এথেকে পিছিয়ে ছিল না। সে শিকার হোক, নাচ-গান হোক বা থিয়েটার, যাই হোক না কেন, এন্টারটেনমেন্ট মাস্ট।
আমি দুটো গুহার কথা আজ আপনাদের সামনে এনেছি। এই গুহাগুলো ছত্তিশগড়ের সরগুজা জেলার অম্বিকাপুরের কাছে রামগড় পাহাড়ে দেখতে পাবেন। আমি কিন্তু যাইনি সেখানে। আপনারা ঘুরে আসতে পারেন।
এই রামগড় পাহাড় কমবেশি হাজার দুয়েক ফুট উঁচু। এখানে রঘুনাথজীর একটা মন্দির আছে। বছরে একবার এখানে বড় মেলা হয়। এই পাহাড়ের উত্তর দিকে দুটো গুহা আছে। আর এই পাহাড়ের গা বেয়ে প্রায় ১৮০ ফুট লম্বা একটা সুড়ঙ্গও আছে। সুড়ঙ্গর হাইট অনেকটা। স্থানীয় মানুষেরা বলেন হাতী চলে যেতে পারে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে। তাই এই সুড়ঙ্গর নাম ‘হাতীপোল’।
পাহাড়ের উত্তরদিকের ওই গুহাগুলোর নাম ‘সীতাবেঙ্গা’ আর ‘যোগীমায়া’ ।
অনেক আগে একদিন এই জায়গায় বাংলা ১৩০১ সালে হাঁচোড়পাঁচোড় করতে করতে গরমের সময়ে পৌঁছে গেলেন মিঃ ব্লক। একজন ব্রিটিশ। ওঁর আগে ওখানে গিয়েছিলেন আরো দুজন, তাঁদের নাম মিঃ গেসলার আর মিঃ বল। তারাও ব্রিটিশ।
তখন কিন্তু এসব জায়গায় যাওয়া অত সোজা ব্যাপার ছিল না। অনেক কষ্ট করতে হতো, অনেক সাহস লাগত। আর লাগত নতুন কিছু জানার, দেখার প্রবল ইচ্ছা। এঁরা ওই দুটো গুহা সম্পর্কে নিজেদের ভিউ লিখে গিয়েছিলেন। ওঁরা বলেছিলেন, এই গুহাগুলো সাধু সন্ন্যাসীদের থাকার জায়গা ইত্যাদি।
মিঃ ব্লক গিয়ে আর একটু কাজ করলেন। গুহা, লিপি ইত্যাদির ছবি নিয়ে এলেন। ওই গুহার মাপজোক করলেন। ওই দুটো গুহাতেই কয়েক পংক্তি লিপি খোদাই করা আছে। এসব নিয়ে লেগে পড়লেন কাজে। সেসব স্টাডি করে এই সিদ্ধান্তে এলেন, না এটা ওই সাধু-সন্ন্যাসীদের থাকার জায়গা নয়।
উনি বললেন, প্রথম গুহাটি খ্রীষ্টের জন্মের তিনশ বছর আগে নাট্যশালা হিসেবে ব্যবহার হতো। দেখ কী কাণ্ড! গুহার ভেতরটা ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায়, এখানে আবৃত্তি-গাথাপাঠ-গান এবং নাটকের অভিনয় হতো। লিপিগুলো দেখে বিশেষজ্ঞরা বললেন, এই লিপি অশোক লিপিতে ব্যবহৃত ব্রাহ্মী অক্ষরের শ্রেণীতে ফেলা যায়। এই লিপির ওপর নির্ভর করেই মনে করা যায় এই গুহা খ্রীস্টপূর্ব তিনশ বছর আগের।
সীতাবেঙ্গা গুহায় প্রথমেই দেখা যায় হাফ-সার্কল কতকগুলো পাথরের বেঞ্চ। মিঃ গেসলার ভেবেছিলেন এগুলো সিঁড়ি। মিঃ ব্লক বললেন — না, সিঁড়ি হলে গুহার সব জায়গায় থাকবে এবং যেদিকে গুহার প্রবেশপথ নেই, সেখানে এগুলো থাকত না। নর্দমা বলে যা ভাবা হয়েছিল, সেগুলো নর্দমা নয়। কারণ সেগুলোর মুখ কোনোদিকেই খোলা নয়। ওগুলো দর্শকদের আর একধরণের বসার আসন। এসব জায়গায় মোটামুটি পঞ্চাশজন বসতে পারত।
সামনের হাফ সার্কল জায়গাটা নাটকের মঞ্চ বলেই মনে করলেন ডাঃ ব্লক। এর তিন দিকেই বেঞ্চ আছে। বেঞ্চগুলো আড়াই ফুট উঁচু, সাত ফুট চওড়া আর সামনের দিকে ঢালু। গুহার ঢোকার জায়গায় দুপাশে দুটো গর্ত আছে। উনি বললেন, এই গর্তগুলোয় পর্দা লাগাবার খুঁটি লাগানো হতো। শীতকালে ঠাণ্ডা হাওয়ায় দর্শকদের যাতে কোনো কষ্ট না হয়, তাই এই পর্দার ব্যবস্থা ছিল। এই গুহা লম্বায় ৪৬ ফুট, চওড়ায় ২৬ ফুট।
এসব কিন্তু সব ওই মিঃ ব্লকের বিশ্লেষণ। আমাকে কিছু বলবেন না কিন্তু। আমি যেরকম পড়েছি, সেটাই জানাচ্ছি আপনাদের। জানতে বা পড়তে তো কোনো দোষ নেই।
ওই যে প্রথমে বললাম এই গুহাতে খোদাই করা লিপি আছে, সেটা আমি বইতে যেরকম পেয়েছি, সেরকম এখানে লিখে দিচ্ছিঃ
আদী পয়ন্তী হৃদয়ম…।
সভাগ গরু কবয়ো এ রাতয়ম্…।
দুলে বসন্তীয়া হাসাবানুভূতে
কুতুস্কটম এবং অলম গ…।
মিঃ ব্লক এই লিপির অনুবাদ করেছেন এরকম — “কবিরা স্বভাবতঃ মাননীয় হৃদয়কে দীপিত করেন – তাঁহারা…। বাসন্তী পূর্ণিমার দোলযাত্রায় যখন গীতবাদ্য ও রসালাপ চতুর্দ্দিকে চলিতে থাকে, জনগণ তখন যূথিকা মাল্যধারণে স্ফীত হয়”।
দেখুন বাবুমশাইরা, ব্লক সাহেব তো আর বাংলায় এরকমভাবে অনুবাদ করেন নি। কে করেছেন আমি জানি না। ওই যে, প্রথমেই বলেছি টুকলিফাই…
পরের যোগীমায়া গুহার লিপিতে কী আছে দেখবেন? দেখুন আর পড়ুন। সেখানে লেখা আছে—
১. সুতনুকনক্ষ ২. দেবদাসীক্য ৩. সুতনুকনাম দেবসিক্যি ৪. তম কময়িথবল ন শেয়ে ৫. দেবদিনে নম। রূপদখে।
ব্লক সাহেবের অনুবাদ এরকম — “সুতনুকা নামে এক দেবদাসী বালাদিগের নিমিত্ত এই আবাস করেন। দেবদিন নামে চিত্রকর ছিলেন”।
অন্য গুহার লিপির সঙ্গে মিলিয়ে তিনি বললেন, প্রথম গুহায় নাট্যশালা ছিল এবং এই গুহায় সুতনুকা নামে দেবদাসী বালাদিগকে নিয়ে বাস করতেন। উনি রূপদখে’র অর্থ চিত্রকর করেছেন।
গুহা দুটির ছাদে নানা ছবি পাওয়া গেছে। কীরকম ছবি? একজন পুরুষ গাছের নীচে বসে আছে। তার বাঁদিকে নর্ত্তকী ও বাজনদার, ডানদিকে হস্ত্যশ্বরথ সমন্বিত শোভাযাত্রা। ( সত্যি কথা বলছি – হস্ত্যশ্বরথ শব্দের মানে বুঝিনি। মনে হচ্ছে হাতী-ঘোড়া হবে। আপনাদের কী মনে হচ্ছে?)
আর একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গাছের ডালে পাখি আর গাছের নীচে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে বসে আছে, তারা সবাই উলঙ্গ, তাদের চুল বাঁদিকে খোঁপার মত করে বাঁধা। আরেক ছবিতে পদ্মাসনে একজন উলঙ্গ পুরুষ বসে আছে, তার পাশে তিনজন পোষাক পরা পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাড়ির জানলার সামনে একটা সুসজ্জিত হাতী, তার কাছে তিনজন পোষাক পরা পুরুষ, তাদের পাশে একটা রথ। সেই রথে ঘোড়া আছে, রথের মাথায় ছাতা।
এরকমই সব ইনফর্মেশন মিঃ ব্লক আমাদের দিয়ে গেছেন। এই সব ছবি, লিপি দিয়ে উনি আমাদের বলে গেছেন এ আমাদের ভারতের এক প্রাচীন নাট্যশালা।
নাট্যশালা তো নাট্যকর্মীদের কাছে মন্দির। মিঃ ব্লকের দৌলতে আমরা পেয়ে গেলাম এক মন্দির।
এ কি কম কথা?
অমল আলো – এই জার্নালে আমার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে।।আমি আনন্দিত।
এই জার্নালে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং ভালো লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এ এক ভীষণ ভালো কাজ।
অভিনন্দন।
এতো তথ্য সমৃদ্ধ লেখাও সরেস গদ্যে লেখা যায় তা তোমার থেকে শেখার, দাদা। সিরিজ চলতে থাকুক।