অভীক ভট্টাচার্য
দশ
নাটকের চর্চা সমাজ সম্পৃক্ত। কখনোই সমাজ বহির্ভূত নয় – একথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে এবং আজও প্রামাণ্য সত্য। নাট্যশিল্পের নিজস্ব চরিত্র সেই পথকে নির্দিষ্ট করেছে আপন গতিতে। আমাদের বঙ্গ নাট্যচর্চার মানচিত্রে ও ইতিহাসের গতি প্রকৃতিতে তা উঠে এসেছে। গোবরডাঙ্গা জনপদের দীর্ঘ নাট্যশিল্প চর্চার ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখতে পাওয়া যাবে সেই পথের নানা আয়োজন। যার বেশ কিছু ঘটনা আমার লেখায় রেখেছি। আগামীতেও রাখবো।
তবে এই পর্বে যে বিষয়ে কথা বলবো সেই বিষয়টি আজ আর আলোচিত হয় না। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন তা ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এমনকি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে প্রায় ঝড় তুলেছিল। সংগঠনটির নাম ‘গোবরডাঙ্গা থিয়েটার ফেডারেশন।’ এই নামেই গত শতকের প্রায় শেষভাগে গোবরডাঙ্গা জনপদে নাট্যচর্চায় রত প্রায় সকল নাট্যদল মিলিত হয়ে গড়ে তোলে একটি শক্তিশালী সংগঠন। যে সংগঠন এই অঞ্চলের নাট্যচর্চার মান উন্নয়ন সহ নাট্যদলগুলির সমন্বয় ও সহযোগে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। আমি গোবরডাঙ্গা নক্সার একজন নাট্যচর্চাকারী ও কার্যকরী কমিটির সদস্য হওয়ায় বয়সে নবীন হয়েও তাদের কর্মকাণ্ডে বেশ কয়েকবার সামিল হওয়ার সুযোগ পাই এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করি। গোবরডাঙ্গা থিয়েটার ফেডারেশনের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের যে তৎপরতা লক্ষ্য করা যেত তার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনা আজ উল্লেখ করবো।
গোবরডাঙ্গা পৌরসভা পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অডিটোরিয়াম – প্রমথনাথ বোস মেমোরিয়াল হল, যার পরিচিত নাম গোবরডাঙ্গা টাউন হল। আপনারা সকলেই জানেন যে, গোবরডাঙ্গা জনপদের সুসন্তান বিশিষ্ট ভূবিজ্ঞানী প্রমথনাথ বোস। তাঁর নামেই এই টাউন হলের নামকরণ। একমাত্র এই অডিটোরিয়ামটি গোবরডাঙ্গা ও বৃহত্তর অঞ্চলের সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল। গত শতকের শেষ দিকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পরিচর্যার অভাবে বহু ব্যবহৃত টাউন হল ক্রমশ ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হতে থাকে এবং এক সময় মৃতপ্রায় হয়ে যায়। তবুও সংস্কৃতিপ্রেমী গোবরডাঙ্গার মানুষেরা নিজেদের চর্চার ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জোড়াতালি দেওয়া হলে কষ্ট করেই চর্চা চালিয়ে যান। কিন্তু নব্বই দশকের শেষ দিকে হলের পরিকাঠামো এতটাই ভেঙে যায় যে সংস্কৃতিচর্চার কোনরূপ পরিবেশ থাকে না। নাট্যদলগুলিও ক্রমশ অস্বস্ত্বি প্রকাশ করতে থাকে। এই অবস্থায় গোবরডাঙ্গা থিয়েটার ফেডারেশন সভা আহবান করে এবং সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় আগামীতে টাউন হল সংস্কার বিষয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবে। সেইমত পরবর্তীতে গোবরডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে টাউন হলের সংযোগকারী রাস্তার পাশে টাউন হলের সম্মুখে শুরু হয় প্রতিবাদ কর্মসূচি। যেখানে আমিও অংশগ্রহণ করি। এই আন্দোলন ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও উৎসাহ ব্যজ্ঞক। তৎকালীন স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ গোবরডাঙ্গা পৌরসভার কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়। সামগ্রিকভাবে টাউন হল কেন্দ্রিক সে আন্দোলন সংস্কৃতির অঙ্গন ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় সামাজিক স্তরে।
স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেও দোলা লাগে। একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য একটি যৌথ সংগঠনের ছাতার তলায় প্রবীন নবীন নাট্যজনদের উপস্থিতি ও তার আবেগের প্রকাশ আমার কাছে একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা হয়ে রয়ে গেছে যা পরবর্তী দু-আড়াই দশকে আর কোনভাবেই খুঁজে পাইনি গোবরডাঙ্গার নাট্যমহলে।
সেই প্রতিবাদ-অবস্থানে প্রবীন নাট্যজনেদের মুখে এমন কথাও উচ্চারিত হতে শুনেছি যে, নাট্য ও সংস্কৃতিচর্চার এই আন্দোলন ও দাবী যদি কার্যকর করতে হয় তাহলে প্রয়োজনে নাট্যজনেরা স্থানীয় পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে আলাদাভাবে সংস্কৃতির সুস্থ পরিবেশ রক্ষা করবার জন্য। এমনতর স্পিরিট আমাকে আজও উৎসাহিত করে। আমি বহু আলোচনায় বারবার বলেছি, নাট্যচর্চা সমাজ সম্পৃক্ত। ফলে একটি নাট্যদল কোন অংশেই একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের থেকে কম নয়। পথ শুধু শিল্প। শিল্পচর্চাকে হাতিয়ার করে যে পৌঁছে যেতে পারে সমাজের অন্দরে। চাই শুধু সাহস আর সংঘবদ্ধ যাপন। যার অভাব এই সময়ে বারবার টের পাই। তবুও বলবো আজ থেকে এতোগুলো বছর আগে গোবরডাঙ্গা থিয়েটার ফেডারেশন যে যে সংঘবদ্ধ লড়াই করেছিল বহু বিতর্ক সাথে নিয়ে তার ফলাফল কিন্তু পাওয়া গেছিল। স্থানীয় প্রশাসন টাউন হলটিকে মোটামুটি ভদ্রস্থ চেহারা দিয়েছিল।
দারুণ এগোচ্ছে।