থিয়েটারের পথে পথে | অভীক ভট্টাচার্য, পর্ব – ১২

বাঙালীর জীবন ও যাপনে আড্ডা সব সময় ভিন্ন মাত্রা যোগ করে এসেছে। বাঙালী শব্দটা আলাদা করে বললাম তার কারণ এটি ইতিহাস সিদ্ধ। এদেশের অন্য অনেক জাতির ক্ষেত্রে এমন যাপন এতটা বেশি চোখে পড়ে না। একথা আমার বানানো নয়, অনেক অনেক নামী গুণীজনেদের সগর্ব উচ্চারণ তার প্রমাণ। বাঙালীর আড্ডা জমানোর জন্য কোন বিশেষ-স্থান, কাল বা পাত্রের প্রয়োজন হয় না। একসাথে কয়েকজন একজোট হলেই শুরু হয় শব্দের সাথে শব্দের মিলন। তৈরি হয় শব্দজাল। যেখানে বিষয়, বিচার সবসময় যে মারাত্মক গভীর পথে প্রবেশ করে তা নয় বরং বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে দ্রুত ছুটে চলে লাগামহীন আবেগ আর অনুভূতির কথামালার।

এই আড্ডা যেমন ঘরের কাছের মানুষদের মধ্যে চলে, তেমনই চলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, সহকর্মী-সহযাত্রী বা চেনা-অচেনা মানুষদের মধ্যে। আর লাগামহীন আড্ডা কখনো কখনো হয়ে ওঠে বিস্ফোরক বারুদ আবার কখনো বা আবিষ্কার আতুর ঘর হয়ে অপেক্ষা করে সময়ের। এমনতর জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত প্রায় সকল বঙ্গবাসী অথবা বাঙালী। অনেকে অনেকসময় বলেছেন মহানগরী কলকাতার আড্ডার মোহময় চরিত্র সন্বন্ধে। তাকে নিয়ে তৈরী হয়েছে নানা সাহিত্য, নাট্য, চলচ্চিত্র, কবিতা। কিন্তু গোটা বাংলার প্রান্তে-পরিধিতেও এমনতর আড্ডার নানারূপ জড়িয়ে আছে প্রতিটি মানুষের জীবন প্রবাহে। তেমনই এক জনপদ গোবরডাঙ্গা।
সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান-পরিবেশ- রাজনীতি -শিক্ষা সবদিকেই যে অঞ্চলের ইতিহাস সমৃদ্ধ, সেখানেও জড়িয়ে আছে আড্ডার ইতিহাস।

এই কলমে আমি লিখছি আমাদের সে সময়ের নাট্যআড্ডার কিছু সুখ স্মৃতির কথা। গত শতকের শেষভাগে যখন আমার সিরিয়াস নাট্যচর্চার যাত্রা সূচিত হয় তখন সরাসরি এইসব আড্ডায় প্রবেশাধিকার পাই। গোবরডাঙ্গা রেলস্টেশন সংলগ্ন অঞ্চল নানা কারণেই জম-জমাট থাকে। যা অতীতেও ছিল। আর সেই রেল স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে বা তাকে কেন্দ্র করে আশপাশের পরিধির মধ্যেই গড়ে উঠেছিল তৎকালীন গোবরডাঙ্গার বিভিন্ন নাট্য দলের মহলাকক্ষ। যদিও গোবরডাঙ্গার অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে ছিল বেশ করেকটি নাট্যদলের মহলাঘর। কিন্তু আজকের নামজাদা নাট্যদলগুলির শিল্পী কলাকুশলীদের সান্ধ্য মহড়ার ভিড় জমতো এই রেলটেশন সংলগ্ন নাট্যগৃহগুলিতে। মহড়া চলাকালীন মাঝে মধ্যে চা-বিস্কুটের আগমনও ঘটতো স্টেশন প্ল্যাটফর্মের চা-দোকান থেকে। সেইসব মহলাকক্ষে চলতো ঘণ্টার পর ঘন্টা রিহার্সাল। রাতে রিহার্সাল শেষে যে যার নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে একবার অন্তত সবাই মিলিত হতাম এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের কোন নির্দিষ্ট চায়ের দোকানে। একটি বা দুটি নয় একাধিক নাট্যদলের নাট্যজনদের প্রায় প্রতিদিনের মিলনকেন্দ্র ছিল সেই সব চা-দোকান। সোজা বাংলায় বলা যায় ‘চা-এর ঠেক’। এখানেই মত বিনিময় হোতো বাংলা নাট্যের হাল হকিকৎ নিয়ে। আলোচনা হতো কলকাতার নামি-দামী নাট্য প্রযোজনা ও তাঁর দক্ষতা নিয়ে। আবার চূড়ান্ত সমালোচনা থেকে তর্ক-বিতর্কের আবহ তৈরী হতো গরম চা-এর চুমুকে। তবে কখনোই সেই তর্ক স্থায়ী বিরোধ বা বিচ্ছেদ তৈরী করেনি। অন্তত আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকাল পর্যন্ত। সেইসব নাট্য যাপন কালের অন্যতম উন্মাদনা ছিল গোবরডাঙ্গা রেল স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে সারি সারি নাটকের বিজ্ঞাপনের ব্যানার-হোর্ডিং। যা আপনাদের সকলেরই জানা যে, অন্ততঃ এ দেশের কোন স্টেশন চত্ত্বরে এমন প্রদর্শন সাধারণত চোখে পড়েনি। এই সকল ব্যানারগুলি ছিল গোবরডাঙ্গার বিভিন্ন নাট্য সংস্কৃতি চর্চাকারী সংগঠনের, যাঁরা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার দ্বারা স্থান ও আকার নির্বাচন করে সামজ্ঞস্য রেখে প্রদর্শন বা Display করতেন।
আমার দেখা সেই সময়কালে গোবরডাঙ্গার নাট্যদলগুলির পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শনের অন্যতম নজির। সেই সব আয়োজনের রূপরেখাও কখনো সখনো আলোচনায় উঠে আসতো ঐসব চা-এর আড্ডায়।

আর ছিল কৃষ্ণদা’র চা-এর দোকান। যেখানে মিলিত হতেন গোবরডাঙ্গার তৎকালীন বিশিষ্ট নাট্যজন সহ সংস্কৃতি-রাজনীতির বহু মানুষ ; সাথে আমরাও। গোবরডাঙ্গা রেলস্টেশনের তিন নম্বর প্লাটফর্মের গা ঘেঁষে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা অতি সাধারণ সেই দোকানের কর্তাটি লুঙ্গি পড়ে থলথলে শরীরে চা সরবরাহ করে যেতেন আর তেলচিটে কাঠের টেবিলে চা-এর গেলাসে ধোঁয়ায় উঠতো শিল্পের, নাট্যের ঝড়। এ আড্ডায় আজকের অনেক নামী মানুষও অংশগ্রহণ করেছিলেন সে সময়। অথচ সময়ের দ্রুতগামী উড়ালে সব যেন কোথায় ওলোট পালট হয়ে গেল। অথবা বলতে পারি, এ আসলে সময়ের চরিত্র।

আমি কিন্তু এখনও সময় পেলে একবার অন্তত গোবরডাঙ্গা স্টেশন চত্ত্বরে পা ফেলি আর খুঁজে বেড়াই সেইসব দিকচিহ্নগুলি। এক মোহময় আবেশ নিজের ভিতরে বহন করে, চক্কর কাটি এপাশ থেকে ওপাশ। আশে- পাশের কেউ টের পায় না, আমি শুধু দেখি গোবরডাঙ্গা রেলস্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের শেডের নিচে সার দিয়ে সাজানো নাটকের প্রচার-ব্যানার একটাও নেই যা ছিল ভারতে বিরল। আমি দেখি সন্ধ্যা নেমে রাত বাড়লেও প্ল্যাটফর্মের সেই চা-দোকানে নাটকের বন্ধুদের মিলিত শব্দকল্প তৈরি করে না কোন ঐকতান। আমি দেখি তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশে জরাগ্রস্থ কৃষ্ণদার চায়ের দোকান ঝাঁ চকচকে শো-কেস হয়ে গেলেও আর আসে না শিল্পের কাব্যময়, হাঁকডাক।

সময় তবু বয়ে যায় আপন ইচ্ছায়। কিন্তু আমার মজ্জায় যে রসধারা সেই সময় সঞ্চারিত করেছিল নাট্যশিল্প-আড্ডা- পরিবেশ-বন্ধুতা তাকে ভুলতে পারি না কোন মতে। যদি ভুলে যেতাম তাহলে এ কলমের লড়াই থেমে যেত। হয়তো বলবেন ভালো থাকতাম অনেকের মতো, যাঁরা শিল্প-শিল্প, আর্ট-আর্ট করে অথচ সব ভুলে যায়। কিন্তু আমি বলবো, এ আমার ঐশ্বর্য অর্জন, যা আমাকে চলতে চলতে পবিত্র বাতাসে কিছুটা হলেও উড়তে সাহায্য করে। আমি ভেসে যাই সময়ের যাদুচাদর গায়ে আতর সন্ধানে।

3 thoughts on “থিয়েটারের পথে পথে | অভীক ভট্টাচার্য, পর্ব – ১২

  1. শুদ্ধ, স্বচ্ছ বাংলায় জীবনের এমন সব অভিজ্ঞতার কথা শুনতে পড়তে বেশ লাগছে অভীকবাবু। আপনার কলম এগিয়ে চলুক দুরন্ত গতিতে।
    ভালো থাকবেন।

Comments are closed.