থিয়েটারের পথে পথে | অভীক ভট্টাচার্য,পর্ব – ১৩

আমার জন্ম থেকে ২৬ বছর গোবরডাঙ্গা জনপদের সাথে সম্পর্ক ছিল সরাসরি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই আড়াই দশকের বেশি সময়ের স্থানীয় সংস্কৃতির ছোট বড় চর্চা ও তার বাঁকবদল আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সংগৃহীত। তেমনই একটি অভিজ্ঞতার নাম ‘নিয়মিত থিয়েটার’। নাট্যচর্চা নিয়মিত হয়, তাহলে ‘নিয়মিত থিয়েটার’ বিষয়টা আবার কি? একটা নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময় জুড়ে নিয়মিতভাবে নাট্যপ্রদর্শন এমনটাই হলো ‘নিয়মিত থিয়েটার’ সেই প্রদর্শনের একটা পথ নির্মাণ করেছিল গোবরডাঙ্গা নকসা নাট্যদল গত শতকের শেষভাগে। এমন একটা পরিবেশ তৈরি হতো এ নিয়মিত থিয়েটারকে কেন্দ্র করে যেন মনে হতো এক রঙিন উৎসব। তো, সেই উৎসবের কেন্দ্রস্থল ছিল গোবরডাঙ্গা টাউন হল ( ভালো নাম – পি এম বোস মেমোরিয়াল হল )।

যে প্রেক্ষাগৃহটি তৎকালীন বৃহত্তর গোবরডাঙ্গা শিল্পচর্চার একমাত্র আস্তানা হিসাবে জেগে ছিল কোনমতে। আর ছিল একটি সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল – ‘স্মৃতি’। নামের মাহাত্ত্বে এই সিনেমা হল এখন স্মৃতি হয়েই দাঁড়িয়ে আছে গোবরডাঙ্গা জনপদের বুকে। তবে টাউন হলটি সংস্কার হয়ে ঝকঝকে প্রেক্ষাগৃহে পরিণত হয়েছে।

যাই হোক ফিরে আসি মূল বিষয়ে। সেই ভগ্নপ্রায় টাউন হলেই শুরু হয়েছিল গোবরডাঙ্গা নকসা আয়োজিত ‘নিয়মিত থিয়েটার’। আমি তখন এই নাট্য দলের সম্পাদক। একটি ঐতিহ্যশালী নাট্যদল যারা গোটা বাংলা জুড়ে, মঞ্চের পর মঞ্চ দুর্দান্ত সব নাটক উপহার দিয়ে চলেছে। সেই নাট্যদল আয়োজন করেছে একটি নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনের উৎসব। হ্যাঁ উৎসব, কারণ এই আয়োজনটি করতে গিয়ে তার প্রস্তুতি উপস্থাপনা পদ্ধতি ছিল রীতিমত লড়াকু।

আমার মনে হয় একটি নাট্যদলকে তার শিল্পচর্চার ও প্রদর্শনের পথ দূরগামী করতে সব সময় জনসংযোগের নিবিষ্টতায় পৌঁছানো চেষ্টা করতে হয়। ফলে মানুষের সাথে সমাজের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে এ ধরনের আয়োজন আরো বেশী করে উৎসাহিত করেছিল আমাদের। নিয়মিত থিয়েটার হবে গোটা বছর ধরে প্রতিমাসের নির্দিষ্ট দিনে। যেখানে স্থানীয় ও আমন্ত্রিত নাট্যদলের প্রযোজনা উপভোগ করবেন দর্শকরা। সে কারণে তৈরি হলো সিজন কার্ড।অর্থাৎ সারা বছরের জন্য একটি কার্ড। শুরু হলো পরিচিতজন এবং সেই সাথে নতুন করে পরিচিত হওয়া। মানুষজনের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে আলাপ ও উৎসবের বিষয়ে কার্ড পৌঁছে দেয়া এই নেটওয়ার্কটি কিন্তু শুধুমাত্র গোবরডাঙ্গা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্বার্শবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষ করে মেদিয়া পাঁচপোতা ঠাকুরনগর গাইঘাটা চাঁদপাড়া মছলন্দপুর চাতরা নকপুল হাবরা অশোকনগর ইত্যাদি অঞ্চলে আমাদের পরিচিতজনদের কাছে পৌঁছে গেছিল নাট্যের সুবাদে আর সেই সাথে ছিল প্রচার অভিযানের কাজ। যেসব আজ হয়তো গল্প। গোবরডাঙ্গার মূল আকর্ষণ রেলস্টেশনের ১ নং প্লাটফর্মে ব্যানার লাগানো তো ছিলই, সেইসঙ্গে সমগ্র গোবরডাঙ্গার প্রধান রাস্তা জুড়ে বিভিন্ন আলোক স্তম্ভে ছোট ছোট ব্যানার আর হ্যান্ডবিলের মাধ্যমে ব্যবসায়ী, সাধারণ পথচারী, জনগণের সাথে সংযোগ। মফস্বল গ্রামের পথে পথে মাইক্রোফোনে প্রচার।

এসব হয়তো অনেকের কাছে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি হতে পারে। কিন্তু আজ যখন এতটা পথ পিছিয়ে এসে সেই স্মৃতি পথে হেঁটে যাই তখন ভাবি, সেই সময় ছিল না কোন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের রমরমা। ছিলনা ঘরে বসেই মোবাইলে বোতাম টিপে নেমন্তন্ন করার প্রথা, ছিলনা মোবাইল স্ক্রিনেই শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের ব্যানার আপলোড করে প্রচারের সাফল্যে ডুবে থাকা। দলের অফিস ঘরের পাখার তলায় বসে অথবা ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ঘেমে স্নান করেও মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চলত প্রস্তুতি। তার সাথে ছিল নিয়মিত টাউন হল পরিদর্শন। যেখানে প্রতিটি নিয়মিত থিয়েটার প্রদর্শনের দিন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতো অতিরিক্ত চেয়ার বা আসনের ব্যবস্থা।

নকসার আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই নিয়মিত থিয়েটার নিজেদের নাট্যপ্রদর্শনের পাশাপাশি ছিল আমন্ত্রিত নাট্যদলের প্রদর্শন। এককথায় ঢল নামতো হল জুড়ে। মঞ্চ, সাজঘর, দর্শক আসনের পরিকাঠামো নিম্নমানের হলেও আমাদের উদ্বোধন উৎসাহ ও আন্তরিক আয়োজনে যেন ছিল প্রাণের স্পন্দন। বলে রাখা দরকার যে, সেই সময় ছিল না কোন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।

তবু আমাদের নিয়ন্ত্রণে এই অঞ্চলের অাপামর সাধারণ মানুষ ভরিয়ে তুলতেন প্রেক্ষাগৃহ। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল লক্ষ্য করার মতো যা আজকের বাংলা নাট্যচর্চায় লুপ্তপ্রায়। নিয়মিত থিয়েটারের দিনগুলিতে গোবরডাঙ্গা অঞ্চলের প্রায় সকল নাট্যদলের নাট্যবন্ধুরা উপস্থিত হতেন এবং বিভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ করে আয়োজনকে সফল করে তুলতেন। এই ধরনের সংগঠিত সংযোগের পরিবেশ গোবরডাঙ্গার নাট্য অঙ্গনে পরবর্তীতে বেশ কিছুকাল লক্ষ্য করলেও সময় যত গড়িয়েছে তা ক্রমশ উধাও হয়ে একেবারে বিলুপ্তির পথে চলে গেছে।

স্বাভাবিকভাবেই আজকের গোটা সমাজের যে আদর্শ ও মূল্যবোধের এক ধরনের দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে তার প্রভাব তো নাট্যচর্চার অঙ্গনে চাপ ফেলবে। সেই উপলব্ধি থেকে আরও বেশী বেশী করে সেই সব সময়ের ছবিগুলো উঠে আসে যা এই আকালেও উজ্জীবিত করে এমন একটি শিল্পের সাথে সবসময় লেপটে থাকতে।

এই পর্ব শেষ করব একটা অনুভূতি বা উপলব্ধির কথা বলে যা আমার একান্ত ব্যক্তিগত। আমার নাট্যচর্চার যে পরিসর, তার সমষ্টিগত চরিত্র ও বিচরণ তার সাথে ভীষণভাবে মিল খুঁজে পাই একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক সমষ্টির বিচরণের সাথে। যা সবসময় সামাজিক সংযোগ গড়ে তুলতে চায় বা প্রকৃত অর্থে গড়ে তোলা উচিত। এখানে উভয়ক্ষেত্রের কামনা, বাসনা বা স্খলনের কথা আমি বলছি না। সক্রিয়তা, সংযোগের ক্ষেত্রে উভয়ের চলন সমান, পার্থক্য এক জায়গায়। তা হল, একটি শিল্পকলার সূক্ষ্ম চর্চা, আরেকটি সুস্থ সামাজিক চলন নির্মাণের কূটনৈতিক চর্চা।

54 thoughts on “থিয়েটারের পথে পথে | অভীক ভট্টাচার্য,পর্ব – ১৩

Comments are closed.