থিয়েটারের পথে অনন্তকাল হেঁটে যেতে চায় সন্দীপন | বিজয়কুমার দাস পর্ব – ৩৮

বাংলা থিয়েটারে এই সময়ে একটা শক্তিশালী অভিনয় প্রজন্ম উঠে এসেছে একথা আমি বারবার বলার চেষ্টা করে আসছি আমার বিভিন্ন লেখায়। প্রতিদিন বিভিন্ন মঞ্চে থিয়েটারের উজ্জ্বল পতাকা ওড়াচ্ছে তারা। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাদের একজন। ভীষণ মজার মানুষ, মিশুকে। আর পাঁচজনের মত পাড়ার থিয়েটারে প্রথম মঞ্চে উঠলেও সেই থিয়েটার তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। অভিনেতা সন্দীপনও জীবনের সঙ্গে থিয়েটারকে জড়িয়ে রেখেছে। আসলে তার জীবনের পথচলায় এমন কিছু মানুষের যোগ ঘটেছিল, যার কারণে সন্দীপন থিয়েটারের পথটা খুঁজে পেয়েছিল। থিয়েটারের অনন্ত যাত্রাপথে তাই সন্দীপন এক দায়বদ্ধ পথিক।

বেলুড়ের ছেলে সন্দীপন সাধারণ পরিবারে বেড়ে উঠেছে। বেলুড়ের বাড়ির কাছে শান্তিনগর অধিকারীপাড়ায় লালুমামা ( রবীন্দ্র ভৌমিক) নামে পরিচিত পাড়ায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে। লালুমামা অবশ্য নাটকও করতেন। সেই লালুমামার উদ্যোগে পাড়ার নাটকে প্রথম মঞ্চে পা রেখেছিল সন্দীপন নামের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া শিশুটি। সেই ডানপিটে বালকই যে পরবর্তীতে মঞ্চে দাপিয়ে অভিনয় করবে তা কে জানতো! এ কথা ভাবলে সন্দীপনই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়।

প্রথম মঞ্চে ওঠা সেই কবে কোন নাটকে তা ঠিকঠাক পড়ে না সন্দীপনের তবু সেটাই তো আরম্ভের আরম্ভ। পরে বেলুড়ের যুগবাণী সঙ্ঘতেও ডাক পেয়েছিল সন্দীপন অভিনয়ের জন্য। বাঞ্ছারামের বাগান, অদল বাদল নাটকে সেখানে অভিনয় করেছিল। আবার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও নাটকের অনুষ্ঠানে সন্দীপন অনেক সময় হাজির হতো নিজের তাগিদে।
মামা নারায়ণ গাঙ্গুলী অবশ্য থিয়েটার করতেন। অফিস ক্লাব সহ সারকারিনা, রঙ্গনা মঞ্চে। অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু ছিলেন মামা। সেই মামার প্রতি একটা সমীহ তৈরি হয়েছিল ভাগ্নের । আর তিনি মঞ্চের মানুষ, শুধু এই কারণেই এই সমীহ। তবু সন্দীপনের জীবনে থিয়েটার থেমে যেতে পারত পাড়ার থিয়েটারে মঞ্চে ওঠার পরেই।কিন্তু থামেনি একজন মানুষের জন্য। সেই মানুষটির নাম অপূর্ব কোলে। বালি নিশ্চিন্দা চিত্তরঞ্জন বিদ্যালয়ে বাংলা পড়াতেন অপূর্ববাবু। নিজে নাটকও করতেন। বিশেষত রবীন্দ্র নাটক। এই বিদ্যালয়ে পড়তে এসে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছে সন্দীপন। শুধু সান্নিধ্য নয়, অকৃত্রিম ভালবাসা আর প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন এই অপূর্ববাবু সন্দীপনের জীবনে। তিনি বলেছিলেন, নাটক করতে হলে নাটক বুঝতে হবে, নাটক শিখতে হবে। নাটক করার ইচ্ছেটা তখন সন্দীপনের মনে ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে। কুঁড়ি যেমন করে ফুল হয়ে ওঠে, ঠিক তেমন করেই।
ইতিমধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় বেলুড়ের স্বরূপ সরকারের সুচন্দ্রা নাট্য সংস্থায় তসলিমা নাসরিনের রচনা অবলম্বনে ‘লজ্জা’ নাটকে অভিনয় করেছে সন্দীপন। বালী রবীন্দ্র ভবনে এই নাটকে অভিনয়ের পর থিয়েটার করার ইচ্ছাটা তার অনেকটাই বেড়েছে। প্রেরণার প্রদীপটি জ্বেলে দিয়েছেন সেই শিক্ষক অপূর্বস্যার।

একদিকে থিয়েটারের টান অন্যদিকে মধ্যবিত্ত পরিবারের চাহিদা। বাণিজ্য নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ সন্দীপনকে সেটাও ভাবতে হচ্ছিল। তাই হাওড়ার রামরাজাতলায় আই টি আই পড়তে ঢোকে । ২০০২ সালে মাধ্যমিক, ২০০৪ সালে উচ্চমাধ্যমিকের পর সেই জীবন। সেটা শেষ করে আবার বাংলা সাম্মানিকে ভর্তি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। আর বাংলা টিউশন পড়ার সূত্রে সেই অপূর্বস্যারের সান্নিধ্য আবার পেল সন্দীপন। থিয়েটার নিয়ে আবার প্রাণিত করলেন তিনি।
২০০৮ এ জীবন বীমার প্রতিনিধি হিসাবেও কাজ শুরু করে সন্দীপন। সেখানে বন্ধুত্ব হল বেলঘরিয়ার অশেষ ভট্টাচার্যর সঙ্গে। অশেষবাবুর হাত ধরে সন্দীপন পৌঁছল বেলঘরিয়ার নাট্যদলের মহলা কক্ষে। এমনকি টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়, ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে চলে যেত অভিনয়ের ইচ্ছাকে সম্বল করে। থিয়েটার করার ইচ্ছায় সে তখন মন প্রাণ সমর্পণ করে ফেলেছে। অন্যদিকে অপূর্বস্যারের মাধ্যমে যোগাযোগ ঘটল থিয়েটারের অভিনেতা মনসিজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি যুক্ত ছিলেন অন্যকথা দলের সঙ্গে। অন্যকথা দলে পাকেচক্রে সহ চাঁদিপুরের চাঁদকুমার, ছায়া ঘনায়, কাল বিপথে নাটকে অভিনয় করল।
সন্দীপন তখন প্রতি মুহূর্তে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করেছে একজন অভিনেতা হয়ে ওঠার জন্য। পাশাপাশি বিবেকানন্দ সার্ধশতবর্ষে থিয়েটার অঙ্গণে নিজেকে প্রমাণ করার এক সুযোগ পেয়ে গেল সে। তখন থিয়েটার কমিউন এর দায়িত্বে ছিলেন প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত। তিনি বিবেকানন্দকে নিয়ে ‘ জাগ্রত বিবেক’ নাটকে বিবেকানন্দ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচন করলেন। সন্দীপন এই চরিত্রে অভিনয় করে নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করল। পরে এই দলের ‘ছায়াপথের কাছে’ নাটকেও অভিনয় করল সন্দীপন। এসবের পাশাপাশি একটা চাকরির চেষ্টা যেমন চলছিল, তেমনি চাকরির ইচ্ছাটাও লালন করছিল সংসারের প্রয়োজনে। ২০১১ – ১২ সালে লিলুয়ায় ইস্টার্ন রেলে এপ্রেন্টিস হিসাবেও যুক্ত থেকেছে মূলত একটা চাকরির প্রয়োজনেই।

বাংলা থিয়েটারে তখন দেবশঙ্কর হালদার, ব্রাত্য বসু প্রমুখরা মঞ্চ মাতাচ্ছেন। এই দুজন মানুষের থিয়েটারের কাজের প্রতি একটা দারুণ শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছিল সন্দীপনের মনে। দেবশঙ্কর হালদারের মত হুবহু তাঁর অভিনীত নাটকের সংলাপ শোনাতে পারত সে।

শেষ পর্যন্ত এই সন্দীপন ২০১৪ সালে পৌঁছে গেল মিনার্ভা রেপার্টারির দরজায়। নিজেকে অভিনেতা হিসাবে তৈরি করার দরজা তখন তার সামনে খুলে গেছে। যেন আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ পেয়ে গেছে সন্দীপন। ২০১৪ থেকে চার বছর মিনার্ভার জীবন সন্দীপনকে থিয়েটারের জন্য গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। মিনার্ভায় একের পর এক নাটকে সন্দীপন নিজেকে প্রমাণ করেছে।দেবাশিস রায়ের কাঁকড়া, তক্ষক ছাড়াও অন্যান্য নাটকের মধ্যে য্যায়সা কা ত্যায়সা, মৃচ্ছকটিক, খড়ির গণ্ডি, পাঁচের পাঁচালী, পোকামাকড়ের কুটুম। দেবাশিস রায় ছাড়াও, অরুণ মুখোপাধ্যায়, রাজীব বর্ধন, পৃথ্বীশ রানা, সৈকত ঘোষ এবং ব্রাত্য বসুর মত নির্দেশকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ সন্দীপনকে বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে দাপিয়ে Serving সুযোগ করে দিল। ব্রাত্য বসু নির্দেশিত ‘মুম্বাই নাইটস’ নাটকে সন্দীপন বিশেষ করে নজর কাড়ল। পাশাপাশি ব্রাত্যবাবুর স্নেহচ্ছায়া তার অভিনয় জীবনের এক সম্পদ হয়ে উঠল। মিনার্ভার জীবন ফুরনোর পর রাজ্য সরকারের কারা দপ্তরে চাকরি পেয়ে গেল সন্দীপন।

এমন হতেই পারত যে, চাকরি আর সংসারের জীবন তাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারত থিয়েটার থেকে। কিন্তু তার উল্টোটা হল। এসব সামলে থিয়েটার চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তেই অবিচল থাকল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নামের মঞ্চাভিনেতা। কোনো নির্দিষ্ট দলে নয় চাকরির পাশাপাশি শুরু হল ফ্রী- ল্যান্সার হিসাবে থিয়েটার যাপন।
একের পর এক নাটকে সন্দীপন নিজেকে চেনাল থিয়েটারের মঞ্চে। অভি চক্রবর্তীর নির্দেশনায় অশোকনগর নাট্যমুখ প্রযোজিত, ব্রাত্য বসু রচিত ‘আমি অনুকূলদা আর ওরা’ নাটকে ভগবানের ভূমিকায় দর্শকদের চমকে দিল সন্দীপন। একের পর এক চমক থিয়েলাইটের অতনু সরকার নির্দেশিত ব্রাত্য বসুর ‘ভয় ‘, পিয়ালি বসু চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় বিজয় মুখোপাধ্যায়ের নাট্যদল বালিগঞ্জ ব্রাত্যজনে ‘পালক’, পিয়াল ভট্টাচার্যর নির্দেশনায় চন্দননগর সাড়ঙ্গ দলের ‘ নির্বাসিত নায়ক ‘ ছাড়াও থিয়েলাইট প্রযোজিত ‘চুয়াচন্দন’, দুর্গারহস্য, বালিগঞ্জ ব্রাত্যজন প্রযোজিত ‘শ্যামা’ তার অভিনয় জীবনের এক একটা মাইলস্টোন।

বিদ্যালয় জীবনের শিক্ষাগুরু অপূর্বস্যারের মাধ্যমে অন্যকথা দলের নির্দেশক যে মনসিজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় পাকেচক্রে নাটক করেছিল, সেই নাট্যগুরু মনসিজবাবু পরে আলোমুখ নামে নাট্যদল গড়েছিলেন। সেই নাট্যগুরু মনসিজবাবুর আলোমুখ দলে পাঞ্চালীকথা, রামধনু, শেষ বিকেলের আলো, এসোসিয়েশন রাস্কেল নাটকে অভিনয় করেছে।
পাশাপায়াশি ব্রাত্য বসুর “ডিকশনারি ” চলচ্চিত্রে অভিনয় সন্দীপনের অন্য অভিজ্ঞতা। আর সেই অভিজ্ঞতার নিরিখেই ডাক মিলেছে ব্রাত্যবাবুর “হুব্বা ” ছবিতেও।

মিনার্ভার জীবনেই পরিচয়ের সূত্রে অভিনেত্রী সায়ন্তী ঘটককে পেয়েছে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে। চাকরী জীবনেও একজন অভিনেতা হিসাবে সহকর্মীদের কাছে পেয়েছে অফুরন্ত ভালবাসা। তাই থিয়েটারের পথে অনন্তকাল হেঁটে যেতে চায় অভিনেতা সন্দীপন।

22 thoughts on “থিয়েটারের পথে অনন্তকাল হেঁটে যেতে চায় সন্দীপন | বিজয়কুমার দাস পর্ব – ৩৮

  1. বিজয়বাবু আমার প্রণাম নেবেন 🙏🙏
    অভিদা ও অসীমদাকে আমার কৃতজ্ঞতা-ভালোবাসা জানাই❤️❤️

    1. আমাদেরও ভালো লাগছে, তোমার কথা বলতে পেরে অমল আলো তে।
      এভাবেই তুমি এগিয়ে যাও।
      আরো আরো নাম হোক, খ্যাতি হোক।
      অনেক ভালোবাসা তোমাকে।

    1. সন্দীপন বাংলা থিয়েটারের উজ্জ্বল মুখ। অসীম নিষ্ঠায় থিয়েটারকে জড়িয়ে নিয়েছে জীবনের সঙ্গে।সন্দীপনরা দাপিয়ে বেড়াক বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে। অমল আলোয় উদ্ভাসিত এইসব মুখগুলি আরো ভাস্বর হোক।নাট্যমেব জয়তে।

  2. এই নাট্যপথ আরো দীর্ঘ হোক, ইতিহাস সৃষ্টি করুক অভিনয় প্রতিভা।শুভকামনা রইল।

  3. Salute Comrade! শুভেচ্ছা, ভালোবাসা অফুরান। আরো এগিয়ে যাও, নিজেকে থিয়েটার যাপনের মধ্যে রেখে সমৃদ্ধ করো।🙏❤️

    1. অ্যাসোসিয়েশন রাস্কেল এ অভিনয় করার সময় তোমাকে কাছ থেকে দেখেছি। ওই রিহার্সাল এর কিছুদিন তোমার থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তুমি মানুষটা খুব মিশুকে আর একজন খুব এই ট্যালেন্টেড অভিনেতা। আগামীতে যেনো আরো সুযোগ পাই তোমার থেকে আরো অনেক কিছু শেখার।

    2. অনেক অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। প্রিয় মানুষ ও অভিনেতা। এগিয়ে যাও। সঙ্গে আছি।

  4. থিয়েটারের সাথে সাহিত্যটাও চালিয়ে যা দুটোতেই আমারা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।গুরু শিষ্য পরমপরা।

  5. অনেক শুভেচ্ছা রইল। আরো ভাল ভাল কাজ করো।

  6. ভাল থাকিস। তোরা ভাল থাকলেই আমরা ভালো থাকব। 💖💖💖

    1. আমাদেরও ভালো লাগছে, তোমার কথা বলতে পেরে অমল আলো তে।
      এভাবেই তুমি এগিয়ে যাও।
      আরো আরো নাম হোক, খ্যাতি হোক।
      অনেক ভালোবাসা তোমাকে।

  7. ঠিক যেইভাবে এতোটা পথ লড়াই করে, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী হয়ে এগিয়ে এসেছিস। এটাকেই ধরে রেখে এগিয়ে যা…
    প্রতিনিয়ত নতুন ভাবে তোর অভিনয়গুন দেখে আসছি। আরও আরও অনেক সাফল্য কামনা করি তোর জন্য।

  8. প্রিয় বন্ধু, অনেক শুভেচ্ছা রইলো। বাংলা থিয়েটারে ভীষণ প্রয়োজন তোমার মত অভিনেতাদের, আরো সমৃদ্ধ হোক বাংলা থিয়েটার, তোমরাই হয়ে ওঠো, আগামী প্রজন্মের কাছে থিয়েটারের পথ প্রদর্শক।ভালো থেকো বন্ধু, তোমারে সেলাম ।

  9. মানুষের কাছে নিজের কাজে প্রতিষ্ঠিত হও, এই আশীর্বাদ করি।নিজের উপলব্ধির বিবেচনা করে এগিয়ে যাও।আমরা আনন্দিত ,গর্বিত তোমার জন্য।

Comments are closed.