বিজয়কুমার দাস
ত্রিপুরার আগরতলায় থাকা ছেলেটি শৈশবেই পিতৃহীন হয়ে পড়ে। সেই আগরতলা তার শৈশবের স্মৃতি মাত্র। পরিবার প্রধানের মৃত্যুতে বিপর্যস্ত সকলে। দাদু (মায়ের বাবা) সুশীল কুমার নাহা নাতিকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে খড়দহে। তারপর যথারীতি পড়াশুনো করতে করতে ২০০৪ সালে মাধ্যমিক। ছেলেটির লক্ষ্য একজন দক্ষ ক্রিকেটার হওয়ার। সারাদিন খড়দহ মিশনের মাঠে একনিষ্ঠ অনুশীলনে ঘাম ঝরায়। সেই বয়সেই নজরকাড়া স্ট্রাইক বোলার হিসাবে নিখুঁত দক্ষতায় সে তুলে নিতে পারে প্রতিপক্ষের উইকেট।
“থিয়েটার” নামক শব্দটির সঙ্গে তার তখন কয়েক যোজন দূরত্ব। সে কি জানত যে, থিয়েটারের মঞ্চ তার জন্য প্রতীক্ষায় ছিল? সে কি জানত যে, তার মুখে কখনও পড়বে মঞ্চের স্পটলাইট?…
অমল আলো জার্নালের ত্রিশ তম পর্বে আমার এক ভালো লাগা মানুষ সুমিতের কথা লিখতে বসেছি আজ। এতদিনে তাকে ফোকাসে পেয়েছি। চারিদিকের কৃত্রিম প্রতিযোগিতার মাঝে, হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে এক এবং অদ্বিতীয়ম ছেলেটিকে আলাদা করা যাচ্ছে। সে কোনো ডান বামের লড়াইয়ে নেই। ভালো লাগছে এই উদ্ভাসিত আলোয় তাকে নিয়ে কথা বলতে। কথা বলতে কে না চাইবে এই ছেলেটির সাথে — যে কেন নারীই বোধহয় মুখিয়ে থাকে আলাপ করার জন্য! কেনই বা হবে না, বহুগুণের অধিকারী, মিতভাষী, মিশুকে, নিরহংকারী সুপুরুষ আমার চোখে। হ্যাঁ, ত্রিপুরার সেই ছেলেটা সুমিত কুমার রায়ের কথা বলছি। আদ্যপ্রান্ত ঘটনায় পরিপূর্ণ সে নিজেই। তবে ঢোকা যাক সুমিতের অন্তরমহলে।
সে আর এক গল্প। ঐ খড়দহ মিশনের মাঠে এক যুবক একদিন এসে তার বন্ধুদের ডেকে বলে, থিয়েটারের একটা ওয়ার্কশপ হবে, সেখানে তারা যেন যায়। আলোচনাটা কানে গেলেও ক্রিকেটের বল নিয়ে ব্যস্ত থাকা সুমিত সে কথায় কান দেয়নি তেমন। তবে তার বন্ধুদের সঙ্গে নির্দিষ্ট দিনে সেই থিয়েটার ওয়ার্কশপের হলঘরে নিতান্ত কৌতুহলবশত হাজির হয়েছিল সুমিতও। অথচ সুমিত তখন জানত না, এরপর থেকে তার জীবনটা এক অন্য দিকে মোড় নেবে।
সেই ওয়ার্কশপে যিনি প্রশিক্ষক হয়ে এসে কথা বলা শুরু করেছিলেন, তিনি কি কোন জাদুকর?… সুমিতের এটাই মনে হয়েছিল সেদিন। তাঁর কথাগুলো শুনতে শুনতে সুমিত ক্রমাগত একটা অন্য জগতে চলে যাচ্ছিল।দিনের পর দিন অভিজিৎ সোম নামে সেই ব্যক্তি তথা নাট্য প্রশিক্ষক আশ্চর্যভাবে প্রভাবিত করল সুমিতকে। প্রায় চার বছরের এই পর্ব — বদলে দিল সুমিতকে। সুমিতের সঙ্গে বা সুমিতের পরে যারা এই ওয়ার্কশপে এসেছিল তাদের অনেকেই না থাকলেও সুমিত কিন্তু ছিল। সেই মানুষটার কথা শুনতে শুনতে ” থিয়েটার ” নামক শব্দটা তার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিল।
একটা আশ্চর্য দৃঢ়তা, জেদ আর থিয়েটারের প্রতি ভালবাসা এবং একটা বোধের জন্ম হল সুমিতের জীবনে। একসময় সুমিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, থিয়েটারই করবে। আর সেই সুমিত কুমার রায় তারপর থেকে থিয়েটারের মধ্যে থাকতে থাকতে হয়ে উঠেছে মঞ্চের এক শক্তিশালী ও অনিবার্য অভিনেতা। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির বিচারে সেরা চরিত্রাভিনেতার সম্মানের মুকুট উঠেছে তার মাথায় এবছর। অভি চক্রবর্তীর নির্দেশনায় অশোকনগর নাট্যমুখ প্রযোজনায় মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের “মি: রাইট ” নাটকে অভিনয়ের জন্য সুমিতের এই সম্মান।
এই গল্প বলতে বলতে সুমিত যেন সেই অতীতে ফিরে যাচ্ছিল বারবার। সেই ক্রিকেটে কৈশোর, সেই খড়দহ মিশনের মাঠ, সেই হলঘর আর অভিজিৎ সোম নামে সেই জাদুকর। অভিজিৎ সোম বোম্বাই চলে গিয়েছিলেন থিয়েটারের কাজে, কিন্তু বাংলার থিয়েটারকে তিনি উপহার দিয়ে গেলেন সুমিত কুমার রায়ের মত এক দক্ষ অভিনেতাকে।
অথচ সুমিতের বাড়ির মানুষজনের চাওয়া ছিল অন্যকিছু। থিয়েটারের জগৎ সম্পর্কে তাঁরা মোটেই উদার ছিলেন না। সুমিত কিন্তু সেই নিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে থিয়েটারের পৃথিবীতেই পা রাখল। জীবনে প্রথম নাটকে অভিনয় অভিজিৎ সোমের নির্দেশনায় সমরেশ বসুর আদাব থেকে অাদাব লুঠেরা, প্রযোজনা রহড়া থিয়েটার ক্যাম্পেইন।
মাধ্যমিকের পর পড়া বন্ধ হয়ে গেল, থিয়েটারের জন্যই। তারপর স্কুল কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষাগ্রহণের প্রথাগত ডিগ্রীলাভের সুযোগ হয়নি তার। থিয়েটার নিয়েও কোন ডিগ্রীলাভের সুযোগ মেলেনি। তাই উপার্জনের জন্য ছোটখাটো কাজের পাশাপাশি মুক্ত শিক্ষাকেন্দ্র থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বি বি এ ডিগ্রী অর্জন। পাশাপাশি কম্পিউটার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সাইবার কাফেতে কাজ করা শুরু করল। আর সেই সূত্রে পরিচয় হল অভিজ্ঞান ভট্টাচার্যর সঙ্গে।অভিজ্ঞান তখন নান্দীকারে। দুজনের মাথাতেই থিয়েটারের পোকা। সঙ্গে অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত, দেবলীনা ত্রিপাঠী মিলে গড়ে উঠল ফোর্থ বেল থিয়েটার। হ্যামলেট অবলম্বনে অনিরুদ্ধ দাশগুপ্তর পরিচালনায় “হ্যাপিডি ” নাটকে মঞ্চে নামল সুমিত। এরপর , নোবেল চোর, ফিফটিন মিনিটস টু ফেম, স্পটলাইট। পরে অভিজ্ঞানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলল ” খড়দহ রসিকতা” নাট্যদল। এই দলের “ফলসী চড়ার উপাখ্যান’ নাটকে সুমিত নজর কাড়ল সকলের।
এরপর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্রাত্য বসু, দেবাশিস রায়, অভি চক্রবর্তী, দেবাশিস বিশ্বাসের মত বাংলা থিয়েটারের শক্তিশালী সব পরিচালকদের সঙ্গে কাজের সুযোগ এল সুমিতের। হাওড়া থিয়েটার প্ল্যাটফর্মে নাট্যকার ব্রাত্য বসু আর নির্দেশক দেবাশিস রায়ের যুগ্ম রসায়নে প্রযোজিত “ইলা গুঢ়ৈষা” নাটকে, খড়দহ রসিকতার “জ্যান্ত হ্যামলেট”নাটকে দর্শকদের চমকে দিল সুমিত। যে সুমিত জানতই না যে “থিয়েটার গায়ে মাখে নাকি মাথায় দেয়” সেই সুমিত তার অভিনয়ে দাপিয়ে বেড়াল একাডেমি, গিরিশ, মিনার্ভা, মধুসূদন মঞ্চে। অজস্র প্রশংসায় ধন্য সুমিতের ডাক আসতে লাগল নানা নাট্যদল থেকে। দেবাশিস বিশ্বাস পরিচালিত “ইঁদুর ও মানুষ ” নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আবার মঞ্চ মাতাল সুমিত। ঠাকুরনগর প্রতিধ্বনি নাট্যসংস্থায় ভাস্কর মুখার্জির নির্দেশনায় কুরবান নাটকে নতুন চরিত্রে দেখা গেল সুমিতকে।
বাংলা থিয়েটারের শক্তিশালী নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা ব্রাত্য বসুর স্নেহভাজন হয়ে উঠল সুমিত। সে সময় পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ মোহিত মৈত্র মঞ্চে প্রতি রবিবার নাটক নামাতে মনস্থির করল। প্রথম মাসে পরপর তিনটে রবিবারেই সুমিত অভিনীত নাটক পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গর বাণিজ্যে বসতে: লক্ষ্মী, থিয়েটার প্লাটফর্মের হৃদিপাশ এবং ব্রাত্য বসু নির্দেশিত নৈহাটি ব্রাত্যজনের “একুশ গ্রাম “নাটকে বিশেষ চরিত্রে মঞ্চে বিচ্ছুরিত হল সুমিতের অভিনয়ের দীপ্তি।একদা ক্রিকেটার হতে চাওয়া সুমিত বাংলা থিয়েটারের অনিবার্য অভিনেতা হয়ে উঠল।প্রসেনজিৎ বর্ধন তখন দাপিয়ে অভিনয় করছেন বিভিন্ন দলে। তাঁর সঙ্গেও বহু নাটকে
পাল্লা দিয়ে অভিনয় করল সুমিত। প্রসেনজিৎ ও সুমিতের যৌথ নির্দেশনায় “দ্য লাস্ট শাপার” ইংরেজি নাটক ( কাব্যকলা মনন, দেবান্তরা আর্টস) অন্য হাওয়া আনল থিয়েটারে।
কাব্যকলা মনন এর “দ্য কাইট রানার”, প্রান্তিক চৌধুরীর নির্দেশনায় প্রদীপ মজুমদারের দমদম ব্রাত্যজনে ” দেবদাস”, পার্থসারথি রাহার পরিচালনায় অশোকনগর প্রতিবিম্বর “ঠাম্মি”,বারাসাত রমেশপল্লীর প্রযোজনা নির্দেশক সুদীপ সিংহর “বিনয়ের জীবন”, সুমন্ত রায় ও সুমিত রায়ের যৌথ অভিনয়ে “দ্বিধা”, মলয় রায় ও রোকেয়া রায়ের পূর্বরঙ্গ প্রযোজনায় “স্পার্টাকাস”, কাঞ্চন মল্লিকের নির্দেশনায় ইন্দ্ররঙ্গ প্রযোজিত, ব্রাত্য বসু রচিত “একদিন আলাদিন” এ কোরিওগ্রাফি , রবীন্দ্রনগর নাট্যায়ূধ প্রযোজিত ড: দানী কর্মকারের নির্দেশনায় “জীবজন্তু”,দমদম ব্রত্যজনের ব্যানারে ড: দানী কর্মকারের নির্দেশনায় “ভারতপথিক রামমোহন”, মতো নাটক তার অভিনয় জীবনের এক একটা মাইলস্টোন। সাম্প্রতিক পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গের প্রযোজনায় ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী নির্দেশিত উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাট্যরূপে নির্মিত “আলাউদ্দিন ও পদ্মাবতী ” এবং পৃথ্বীশ রাণার পরিচালনায় মনোজ মিত্রের “মহাবিদ্যা” নাটকে সুমিত এখন ত্রাতার মতো সকলের পাশে। এর বাইরেও বেশ কিছু নাটকে নির্দেশনা, সহ নির্দেশনা ও কোরিওগ্রাফির দায়িত্ব পালন করেছে। ব্রাত্য বসুর কালিন্দী ব্রাত্যজনের শিশুবিভাগে “পাণ্ডব গোয়েন্দা”নাটকে নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি কথাকৃতি ,কল্যাণী নাট্যচর্চাকেন্দ্র, বারাসাত রমেশপল্লীর নাটকে কোরিওগ্রাফার হিসাবেও দক্ষতা প্রমাণ দিয়েছে।
আর এবছরটা (২০২২) সুমিতের থিয়েটার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি সম্মান। মফস্বলের অশোকনগরে বসে নাট্যমুখের প্রাণপুরুষ তথা পরিচালক অভিদার ডাকে নিয়মিত অমল আলোতে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মিস্টার রাইট নাটকের রিহার্সাল, গিরিশে ফাইনাল রিহার্সাল দিনের পর দিন বন্ধু ভাস্করের কোরিওগ্রাফি, সহঅভিনেত্রী সঙ্গীতাদির সাহচর্য না থাকলে এ পুরস্কার সম্ভব হতো না বলে আমি বিশ্বাস করি।
আজ ভীষণ মনে পড়ে অভিজিৎ সোম নামের সেই যাদুকর তথা জীবনের প্রথম নাট্য প্রশিক্ষকের কথা। পরিবারের শাসন বারণ পিছনে ফেলে, জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি যে থিয়েটারকে একদা সে আঁকড়ে ধরেছিল সেই থিয়েটার দুনিয়ায় সুমিত আজ সুপরিচিত অভিনেতা। পেছনের সেই ক্রিকেটের বাইশ গজের দিকে তাকানোর সময় নেই। প্রায়দিন কোথাও না কোথাও অভিনয়, প্রশিক্ষকের ভূমিকায় কখনো। আর থামা নয়। আরো অনেক পথ চলতে চায় থিয়েটারের জন্য একদা অনেক কিছু ছেড়ে থিয়েটারে চলে আসা মানুষ সুমিত। কারণ সেই কিশোরকালের জাদুকর অভিজিৎ সোম হয়তো আজও তার কানে কানে অবিরত বলে চলেছেন, ” ফাইট সুমিত, ফাইট। “…
❤️❤️
সত্যিই সুমিত একজন অসাধারণ অভিনেতা। অনেক কিছু জানলাম ওর বিষয়ে, জানার বড়ো কৌতূহল ছিলো। ব্রাভো ব্রাদার….
এমন গুণী মানুষের সাথে কাজ করে নিজেকে গর্ববোধ করছি। ওঁর চলার পথ আরো প্রশস্ত হোক, উজ্জ্বল হোক জীবন তরণী। অনেক ভালোবাসা।
সুমিত আমাদের গর্ব
Love you bro ❤️
ভালো থাকিস ভাই।
আমার সশ্রদ্ধ ভালোবাসা আমার ভাই, বন্ধু, শিক্ষক সুমিতকে। 🙏🙏🙏❤️❤️❤️
সুমিত নাট্য জগতের এক মূল্যবান সম্পদ। আমাদের সবার দায়িত্ব ওর এগিয়ে চলার পথ কে আরো মসৃণ আরো সুগম করে তোলা। আন্তরিক ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা রইল ওর জন্য।
খারাপ সময় কেউ খোঁজ না নিলেও সাফল্যের পর সবাই ভালোবাসা দেখায় !
তোমার এই আত্ম জীবনী পরে ছোটরা প্রেরণা পেলো ❤️