স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলায় যেসব জ্ঞানী, গুণী নাট্যকার, অভিনেতা,পরিচালক এদেশের নাটক ও নাট্যর প্রবাহমান ধারায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁদের মধ্যে উৎপল দত্ত অন্যতম। নাট্যচর্চা, যাত্রা, ফিল্মে অভিনয় এসব ক্ষেত্রে তিনি স্বমহিমায় ভাস্বর। স্বাধীনতা প্রাপ্তির অনেক আগে থেকে দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া দেশকে ঘিরে রেখেছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। মুনাফাবাজ, বেনিয়া ও রাজনীতিকদের মেলবন্ধনে, কালোবাজারি মজুরদারদের তীব্র স্বার্থপরতায় অজস্র লোকের ভিটেছাড়া হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। গ্রামের মানুষ দুটো ভাতের আশায় ভিড় জমিয়েছিল শহরে। শহরেই বা অন্নের সংস্থান কোথায়? তাই মৃত্যু ছাড়া তাঁদের আর কোন সহায় বা সম্বল ছিল না। দাঙ্গা আর দুর্ভিক্ষে বাঙালির মনুষ্যত্বের তলানিটুকুও হয়েছিল নিঃশেষিত। সামাজিক পারিবারিক সম্পর্কের ধারগুলো ভোঁতা হতে হতে ক্ষয়ে গিয়েছিল প্রায়। ধর্মকে কেন্দ্র করে শহর গুলোর অলিগলি মহল্লায় রক্ত গঙ্গা বইলেও তা আটকাবার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের যতখানি প্রচেষ্টার দরকার হত তাতে ঘাটতি ছিল যথেষ্ট। এইরকম জমা জলের মধ্যে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। সে স্বাধীনতা বয়ে নিয়ে এল শিকড়হীন, ছন্নছাড়া মানুষের যন্ত্রণা আর দেশভাগের ফলে নিরন্ন মানুষের হাহাকার। বিভক্ত বঙ্গের অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিপর্যস্ত হল অনেকখানি।
এইসব ঘটনার কিছুকাল আগে উনিশ শতকের তিরিশের দশকে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির বিকাশ ঘটে, তাঁদের নাট্যচর্চার শাখা ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর আগে থেকে মানুষের দুঃখ-দারিদ্র, জীবন সংগ্রামের টুকরো ছবি আর সাম্যের অধিকারের ভাবনা মূর্ত করে তুলেছিলেন তাঁরা। এসবের পাশাপাশি পেশাদারী নাট্যশালায় শিশির ভাদুড়ী এবং অহীন্দ্র চৌধুরী নাট্যচর্চা করে চলেছিলেন সেখানে দর্শক সমাগম নেহাত কম ছিল না।
বাংলা থিয়েটারের তৎকালীন অবস্থার আলোচনা সাপেক্ষে উৎপল দত্তের নাট্য অবদান বিশ্লেষণ করলে এই বরণীয় মানুষটির কাজের খতিয়ান পাওয়া হয়তো সহজ হবে। পরাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলায় ১৯২৯ সালের ২৯ শে মার্চ উৎপল রঞ্জন দত্তের জন্ম। বাবা গিরিজানন্দন দত্ত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হলেও ব্রিটিশ পুলিশবাহিনীতে যোগদানের পর বাড়িতে সাহেবি কায়দায় উৎপল দত্তের ছেলেবেলা কাটে। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে তাঁর নাট্যচর্চার হাতে খড়ি। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব জিওফ্রে কেন্ডালের ‘শেক্সপীরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার’ কোম্পানিতে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন অভিনয় করলেন তিনি। কলকাতায় ফিরে উৎপল দত্ত প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর নিজের নাট্য দল “লিটল থিয়েটার গ্রুপ”। তার আগে অবশ্য গণনাট্য সংঘে বেশ কিছুকাল ছিলেন। L.T.G নিয়ে তিনি মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথমে শেক্সপিয়ারের নাটক বাংলা অনুবাদ ও পরে তাঁর নিজের লেখা নাটক ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’ ( ১৯৬১), ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৬৩), ‘কল্লোল’ (১৯৬৫), ‘প্রফেসর মামলক’ (১৯৬৫), ‘অজেয় ভিয়েতনাম’ (১৯৬৬), ‘দিন বদলের পালা’ (১৯৬৭), ‘তীর’ (১৯৬৭) ইত্যাদি অভিনয় করেন। ১৯৬৫ সালে তাঁর লিখিত ও অভিনীত নাটক ‘কল্লোল’ অত্যন্ত সাফল্য লাভ করে। ১৯৬৯ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ ঋণের দায়ে ভেঙে যায়। দলের নতুন নাম হয় ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ গ্রুপ বা পি.এল.টি। ১৯৭১ সালে ১৫ ই অগাস্ট রবীন্দ্র সদনে অভিনয় করে ‘টিনের তলোয়ার´ এই প্রযোজনা বাঙালির নাট্যচর্চায় একটি ল্যান্ডমার্ক।
বাংলায় সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীর সময়ে রচিত ‘টিনের তলোয়ার’ এ দেশে নাট্যশালার প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য একথা বলা চলতে পারে। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের পটভূমি উনিশ শতকের কলকাতা। চিৎপুর, বউবাজার, শোভাবাজার, নাট্যশালা অর্থাৎ উনিশ শতকে কলকাতা নাট্যশালা , নাট্যাভিনয়, অভিনেত্রী সমস্যা, অভিনয় শিল্পীদের সামাজিক লাঞ্ছনা, থিয়েটারকে কেন্দ্র করে জাতীয়তা বোধের উদ্দীপনা– এসব ইতিহাসের উপাদান এখানে ব্যবহৃত। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের ভূমিকায় উৎপল দত্ত নাটকের সময় কাল নির্দিষ্ট করেছেন ১৮৭৬ সাল। তিনি লিখেছেন— ‘১৮৭৬ সনই সাম্রাজ্যবাদের নিজমুখে মসীলেপনের কুখ্যাত বৎসর। ওই বৎসর বাংলা নাট্যশালার টিনের তলোয়ার দেখিয়া ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া বৃটিশ সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করিয়া নাট্য নিয়ন্ত্রণের নামে নাট্যশালার কণ্ঠরোধ করিবার ব্যবস্থা করে’। বারাঙ্গনা ও যাত্রার দলের অভিনেত্রী ব্যতীত তথাকথিত ভদ্র ঘরের মহিলারা উনিশ শতকে তেমন অভিনয় করতেন না। বেশ্যা অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল পত্রিকায় আন্দোলন চলেছিল বহু কাল। ইংরেজ মিশনারী সরকারি পরিচালক ও শিক্ষকদের অবিরাম পরামর্শ ও মন্ত্রণা এর বিরুদ্ধে ছিল। ‘বিদ্যা সুন্দর’ সম্পর্কে ১৮৫০ সালে ‘Calcutta review’ পত্রিকার মতামত এই যে এটি ‘immoral’ যাত্রা নাটক দেখতে মেয়েদের নিষেধ করে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা লিখেছিল— ‘হিন্দু শাস্ত্রকারগণ স্ত্রীলোক দিগকে যাত্রা উৎসবাদি দর্শন করিতে নিষেধ করিয়াছেন, ইহাতে যোগ দিলে তরলমতি স্ত্রীলোক দিগের বিশেষ অনিষ্ট সম্ভাবনা।’ ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে বসুন্ধরা ,কামিনী, ময়না এইসব অভিনেত্রীরা সহ অভিনেতা এবং সমাজের কাছে কম গঞ্জনা ভোগ করেনি। ১৮৭৩ সালে অভিনেত্রীরা মঞ্চে অবতীর্ণ হলে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা আরও লেখে— ‘নাট্যশালায় অসম্মানিত স্ত্রীলোকের অধিকার সকল অনর্থের মূল।’ এমনকি নাট্যকার মনমোহন বসু পর্যন্ত এই ব্যাপার মেনে নিতে পারেননি। ১৮৭৩ সালে জাতীয় নাট্য সমাজের সাম্বৎসরিক উৎসবের সময় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন— ‘ভদ্র যুবকগণ আপনাদের মধ্যে বেশ্যাকে লইয়া আমোদ করিবেন, বেশ্যার সঙ্গে একত্র সাজিয়া রঙ্গভূমিতে রঙ্গ করিবেন, ইহাও কি কর্ণে শুনা যায়? ইহা কি সহ্য হয়?’ এর উল্টোটাও ঘটত। স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ‘টিনের তলোয়ার’ এর ময়নার মতো সবজি বিক্রেতা নারী থিয়েটারে এলে বড় মানুষের রক্ষিতা হতে বাধ্য হতো। ১৮৭৪ সালে খ্যাতনামা অভিনেত্রী গোলাপসুন্দরী গোষ্ঠবিহারী দাস কে বিবাহ করেন। মনমোহন বসুর ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় একটি গান ছাপা হয়,
“আজ বঙ্গদেশে কে এক যুবতী এসে,
লীলা উদ্দেশে, ভ্রমে সতী বেশে
উন্নতি উন্নতি মুখে ঘোষে,
রঙ্গভূমি রঙ্গে নাচে হাসে
সত্যি গো বারবধূ যখন ছিলে গো
শত-পতি-বধূ ছিলে গো
ঐ সেই মধুর তিনরূপ
যথা পতি-নিধি-বিধি মিলিয়ে ছিলে”
দীর্ঘকাল ধরে নানা কটুক্তি অপবাদের সঙ্গে লড়াই করে এঁরা রঙ্গমঞ্চে নিজেদের স্থান করে নেন। তিনকড়ি, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, সুশীলাবালার মতো আরও অনেক অভিনেত্রী খ্যাতনামা হয়ে উঠেছিলেন সামাজিক রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে। অনেক মহিলা শিল্পী লোকসংস্কৃতির জগত ছেড়ে যাত্রা, পাঁচালী আখড়াই, হাফ আখড়াই তরজার পরিসর ছেড়ে pygmallion এর নায়িকার মতো শিক্ষিত সমাজে গৃহিত হওয়ার জন্য খোলনলচে পাল্টে চলনে বলনে পোশাকে আধুনিক হয়ে উঠলেন। ব্রিটিশের অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বঙ্গদেশের থিয়েটারের প্রাণশক্তি হরণ করে নিয়েছিল। বাণিজ্যিক সাধারণ রঙ্গালয়গুলি অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে লড়াই করে যাচ্ছিল প্রাণপণ। চারপাশের সকল রকমের মার, রাষ্ট্রের— মার, সামাজের মার, বাংলা থিয়েটারের সেই কোনঠাসা অবস্থার কথা উৎপল দত্ত উপস্থাপিত করলেন ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে। নাটকের মধ্যে নাটক নিয়ে এসে নাটককার। তিনি দেখালেন পরাধীন দেশের ব্রিটিশের আইনের চাপে পদানত প্রাণহীন থিয়েটারে বেঁচে থাকার একান্ত প্রয়াস। সত্যজিৎ রায়ের মতে— ‘টিনের তলোয়ার’ থিয়েটার হল আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের সর্বোচ্চ শিখর। ২০০৫ সালে ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার বলেছিলেন যে উৎপল উনিশ শতকের নাট্য সমাজটা কত নিখুঁতভাবে জানতেন ‘টিনের তলোয়ার’ পড়লে তা বোঝা যায়। ওই সময়ের কোনো লিখিত ইতিহাসেও সমাজের বিচিত্র স্তর বিন্যাসের এরকম যথার্থ ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না’। সংলাপ ও চরিত্র সৃষ্টির সততায় উনিশ শতকের বাবুসমাজ প্রভাবিত কলকাতা কেন্দ্রিক থিয়েটারের অন্দরমহল এখানে উদঘাটিত। শাণিত , বুদ্ধিদীপ্ত, আয়রনির ঝলকে, চরিত্রগুলির প্রাণপ্রতিষ্ঠায়, আবেগের জোয়ার ভাঁটায়, কল্পনাও বাস্তবের নিরন্তর আসা-যাওয়ায় ‘টিনের তলোয়ার’ বাংলা নাটকের মূল্যবান সম্পদ। উনিশ শতকের যে নবজাগরণ, সেকালের সমাজের সর্বস্তরে তার ছোঁয়া লাগেনি– এ সার সত্যটিও বিবৃত করেছেন এ নাটকে নাটককার। এই নাটকে কাপ্তেন বেনীমাধব চাটুজ্যের থিয়েটার ‘দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’র নতুন নাটক ‘তিতুমীর’ লিখে এনেছিলেন শিক্ষিত ইয়াংম্যান প্রিয়নাথ মল্লিক, সেই নাটক পাঠ করে বেনীমাধব বলেছিল— “শালা রক্তের মধ্যে ঢুকে যায় এমন সব চোখা-চোখা কথা, লেখা ভালো”। –অথচ প্রিয়নাথ মল্লিকের স্বদেশ প্রেমের নাটককে বেনীমাধব ব্যঙ্গ করেছিল, গালি গালাজও কম করেনি। কিন্তু এটাও বুঝেছিল যে ‘ময়ূরবাহন’ নাটকে রাজা রাজড়ার কাহিনীতে দর্শকের মন ভরে না, থিয়েটারকে ভালোবেসে, থিয়েটারকে জীবনের সঙ্গে নাগপাশে বেঁধে নিয়ে, সমঝোতার পথ ছেড়ে বেনীমাধব শেষ পর্যন্ত প্রিয়নাথ রচিত ‘তিতুমীর’ নাটক অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নিল। তিতুমীর ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহের নাটক, থিয়েটারের মধ্যে রাজনৈতিক থিয়েটার করার চেতনায় সামিল হল ‘গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’। এই নাটকের ভূমিকায় লেখক প্রণাম জানিয়েছেন— ‘যাঁহারা পশুশক্তির ব্যদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয় বেদনাকে দিয়েছিলেন বিদ্রোহ মূর্তি, যাহারা বহু পত্র পত্রিকা, বহু বাচস্পতি— শিরোমণি, বহু রাজা মহারাজার শত পদাঘাতে জর্জরিত, যাঁহারা অপাংক্তেয় ছোটলোকের আশীর্বাদ-ধন্য, যাঁহারা ভালবাসার বিশাল আলিঙ্গন উন্মুক্ত করিয়া জনগণের গভীরে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। যাঁহারা সৃষ্টিছাড়া, বেপরোয়া, বাঁধনহারা। যাহারা মাতাল, উদ্দাম, সৃষ্টির নেশায় উন্মাদ যাহাদের উল্লসিত প্রতিভায় সৃষ্টি হইল বাঙালির নাট্যশালা, জাতির দর্পণ, বিদ্রোহের মুখপাত্র’।
শেষ পর্ব আগামী সংখ্যায়
জরুরি আলোচনা। টিনের তলোয়ার অমর কাজ।