অন্য মানুষ – তীর্থঙ্কর চন্দ | সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায়

একটি ক্ষুদ্র তৃণ যখন আকাশের ওই বিশাল সূর্যের দিকে হাত বাড়ায়, তখন কি তাকে ছুঁতে পারে ? না, পারে না। কিন্তু তার তাপেই বাঁচে সে। নিজেকে মেলে ধরে জীবনের দিকে – তীর্থঙ্কর চন্দ হচ্ছেন সেই সূর্য আর আমি সুচরিতা সেই ক্ষুদ্র তৃণ। আমার পক্ষে কি সম্ভব তাঁর মতো এই বিশাল মানুষটাকে ছুঁতে পারা ? কিন্তু তবুও এই দুঃসাধ্য কাজটা আমাকে করতে দিয়েছে অমল আলো জার্নাল এর সম্পাদক । আমি চেষ্টা করছি মাত্র।
তীর্থঙ্কর চন্দ শুধু থিয়েটারের জন্য নন, একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে আমার মতো অনেকের আরাধ্য তিনি। অনেকের জীবনপথে সঠিকভাবে চলার মাস্টারমশাই তিনি। সকলের জন্য তাঁর দরজা উন্মুক্ত। তাই সাহস করে তাঁকে যতটুকু বুঝেছি, আমার লেখাতে তাঁর স্পর্শটুকু থাক। বুনে যাব শুধু সেইটুকুই।

জন্ম আসামের কোলে, জেলা কাছাড় গ্রাম উধারবন্দ। আসামের মৃদু মাটির গন্ধ তাঁর জীবন জুড়ে শিক্ষক বাবার অনমনীয় দৃঢ় রাজনীতির আদর্শের বাতাবরণে ছোট থেকে বড় হওয়া। কমিউনিস্ট রাজনীতির ওলটপালট অবক্ষয়ের মধ্যে অনেক লড়াইয়ের কাঁটা পেরিয়ে পরিবারের সঙ্গে বেঁচে থাকা। তাই বোধহয় এতো মাটি আঁকড়ে থাকেন। অসাধারণ পণ্ডিত তীর্থঙ্কর চন্দ সাইটোজেনেটিক্সে ডক্টরেট। কিন্তু তাঁর এই পাণ্ডিত্য ভেকধারী মুখোশ নয়, স্বচ্ছ সরলতায় ভরপুর তাঁর এই মেধা। সেই ছোঁয়া থিয়েটারের অনেক মানুষই পেয়েছেন।

তাঁর আদিবাড়ি কুমিল্লা জেলার আখাউড়া সাবডিভিশনের দেবগ্রামে। ওই অঞ্চলে তাঁর পূর্বপুরুষ ‘মেহারি-র চন্দ’ নামে যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ঠাকুরদার ছিল সোনার ব্যবসা – বার্মাতে ছিল ঠাকুরদার বিরাট দোকান। তাঁর বাবা শান্তিরঞ্জন চন্দ ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছেন আসামের শিলচরে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় বোমা পড়ে ঠাকুরদার সোনার দোকান ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ফলে একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় ঠাকুরদা কোলকাতায় চলে আসেন। ছেলে শান্তিরঞ্জনও এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে কোলকাতায় এসে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। বাইরের যুদ্ধ তাঁর ভিতরের জীবনে এসে বাসা বাঁধে – শুরু হয় তাঁর এক অসম্ভব লড়াই – আর তাঁর এই লড়াইয়ে যোগ্য সহযোদ্ধা ছিলেন মা হেনা দেবী। বড়দিদি অরুন্ধতী যিনি ছেলে হওয়ার সময় মারা যান। আরেক দিদি ছোটবেলাতেই তাঁদের ছেড়ে চলে যান। আছেন অদিতি – দাদার রাঙাদিদি। তিন ভাই – বড় ভাই দীপঙ্কর – ছোট ভাই শুভঙ্কর – মাঝে তিনি তীর্থঙ্কর – এই ছিল তাঁদের পরিবার যাপন।

বঙ্গবাসী কলেজ শেষ করে যখন তাঁর বাবা শিলচরে ফিরে যান, সেখানেই পাঠ নেন কমিউনিস্ট রাজনীতির – কিন্তু সেই রাজনীতির টালমাটাল সময়ে ভেসে যান নি তিনি। অদ্ভুত দৃঢ়তায় শিরদাঁড়া টানটান করে শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন তাঁর নিজস্ব মতাদর্শ। এই লড়াই তাঁর চলেছে আজীবন – স্বস্তির জীবনকে তিনি দু-হাতে সরিয়েছেন। মা হেনাদেবীও ছিলেন তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী। শিলচরের ঝাঁসি ব্রিগেডে অতি কিশোরী অবস্থায় যোগদান – এবং পরবর্তীতে গ্রামের হাইস্কুলের বড়ো দিদিমণি। কলেজজীবনের আরম্ভে ছাত্র-কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী তাঁর মা সাংস্কৃতিক জীবনেও অত্যন্ত প্রতিভাময়ী ছিলেন। শোনা যায় তাঁর মা-কে শিলচরের প্রথম মহিলা অভিনেত্রী বলা হত। আর্যপট্টি-র ব্যানার্জীবাড়ি ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী গুণী পরিবার, এ হেন বাড়ির মেয়ে তাঁর মা – প্রায় ওই সময়ে যখন অসবর্ণ বিয়ে ছিল অতি গর্হিত কাজ, সেই অসাধ্যসাধন করেন মা হেনা দেবী। দাদার বাবা-মা-এর বিয়ে হয়ে যায় শালগঙ্গার এক নির্জন পরিবেশে কমিউনিস্ট পার্টির কৃষকসভার এক সক্রিয় কর্মী নিশিজ্যাঠার বাড়িতে কতিপয় মানুষের উপস্থিতিতে – সূচনা হয় দুঃখ-সুখ পাশাপাশি থাকা এক অসম্ভব লড়াই-জীবনের এরপরে দীর্ঘ পথচলা জেলজীবন – সংসারজীবন – সংগ্রামজীবন সব মিলেমিশে একজীবন হয়ে গিয়েছিল তীর্থঙ্কর চন্দ-র বাবা-মা-এর ঘরসংসার। এ এমন এক যাযাবর জীবন যে, ঘরসংসার অনেক সময় বস্তাবন্দী হয়েই থাকত। কত বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্য – বঞ্চনার শিকার তাঁদের জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলো সাধারণ অথচ অসাধারণ এক পরিবারের – জীবন যুদ্ধের কথা বলতে গেলে হয়তো এক উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। তাই কেবল আমার অনুভবে তীর্থঙ্কর চন্দ-র যাপনের স্পর্শ থাক এই লেখার মধ্যে।

তীর্থঙ্কর চন্দ – একটি নাম একটি – নাকি এমনই এক নাম যিনি হেলাভরে ঠেলে দিতে পারেন তাঁর নামের আগের ডক্টরেট ডিগ্রি – যিনি অনায়াসে এই, হ্যাঁ এই সমাজের ঘৃণ্য রাজনীতির খেলায় না ডুবেও আষ্টেপৃষ্ঠে তাঁর কলমের ধার দিয়ে ফালা-ফালা করে চিরে দিতে পারেন রাজনৈতিক অসভ্যতার চূড়ান্ত মুখোশ – আবার অন্যদিকে রাস্তার পাশে কাজের জন্য বসে থাকা সার-সার মজুর কৃষকদের নিপীড়িত কষ্ট তাঁকে বেদনায় দগ্ধ করে – কৃষকের অধিকারের লড়াই তাঁর তীক্ষ্ণ কলমের আঁচড়ে আগুন হয়ে জ্বলে – কিংবা সেই নিরহংকারী মানুষটি ছাত্রদের শেখাতে গিয়ে নিজেই ছাত্র – হয়ে বসে পড়েন তাঁদের পাশে। কত সহজ সরল যুক্তিতে জটিল সমস্যাগুলি আরামে করে ফেলেন সমাধান – কত মানুষের দুঃখের সাথী হয়ে তাদের দুঃখ মোচন করেন তাঁর বুকের মোচড়ে বাসা বাঁধে এক অন্যজীবন যেখানে স্বার্থহীন – সরল স্বচ্ছ নরম অথচ দৃঢ় টানটান শিরদাঁড়ায় ঋজু এক মন বাস করে – তিনিই তীর্থঙ্কর চন্দ। আর এই তীর্থঙ্কর চন্দকে একবুক ভালবাসা দিয়ে গভীর বটবৃক্ষের আশ্রয়ে যিনি ঢেকে রেখেছিলেন তিনি ছিলেন কিশোরীমোহন বিজয়ার জ্যেষ্ঠা কন্যা সুজাতা, সুজাতা গোস্বামী। এক গভীর অন্তহীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী মমতাময়ী নারী, তীর্থঙ্কর চন্দের জীবনচর্যা – মননচর্চার বড়ো নির্ভরতা ছিলেন তিনি – অথচ তাঁর ভিতরবাড়ি খালি করে বড়ো অসময়ে চলে গেলেন তিনি।

বি.এসসি. পাশ করার পর দাদা ভর্তি হন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এস.সি. শেষ করার জন্য। ওইখানেই আলাপ সুজাতা বৌদির সাথে – বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনই গভীর নিবিড় কালো চোখের প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী রোগা মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় শিলচরের মুখচোরা যুবকটির – ধীরে ধীরে তাঁদের পরিচয় হয়। আসে প্রেম – এ প্রেম আদর্শের – এ প্রেম নির্ভরতার – এ প্রেম পারস্পরিক মায়ার বাঁধনের। দীর্ঘ ৩০-৩২ বছরের বিবাহিত জীবন যেন বাঁধা পড়ে কী এক অদৃশ্য আবেগের সুতোর জালে জড়িয়ে – বৌদির মারণরোগ যা ছিন্ন করতে পারেনি – তাই আজও তিনি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পান নাকি শুনতে পান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিমলা এক্সকারশনে বৌদির চোখ বন্ধ করে হাঁটুতে হাত রেখে একমনে গেয়ে যাওয়া গান – ‘এপারে মুখর হলো কেকা ওই, ওপারে নীরব কেন কুহু হায়’ – কিংবা তিনি যখন সুজাতা বৌদিকে অবাক করে দেওয়ার জন্য তাঁর কাজ থেকে ফেরার সময় গিয়ে হাজির হন স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে, সত্যিই বৌদি অবাক হতেন – খুশি হয়ে উঠতেন কিশোরীর মতো। তাঁর মনের সমস্ত ভালোলাগাটুকু, ভালোবাসাটুকু একমুখ হাসিতে ছড়িয়ে পড়তো। তারপর দুজনে বাকি রাস্তাটা কথকতা করতে করতে হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। আদ্যোপান্ত থিয়েটারে প্রতিটি কোণে ডুবে থাকা এক মানুষের প্রতি সুজাতা বৌদির কোন অভিযোগ কোনদিন ছিল কি ? ছিল হয়তো – প্রকাশ করেন নি – গভীর নীরবতায় চুপ থেকেছেন – যাতে দাদার নাট্যচর্চায় ব্যাঘাত না ঘটে। সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটির ঢাল হয়ে থেকেছেন নীরবে, এ এক অনন্ত প্রেম। আজ যেখানে সমাজের শিরায় শিরায় শুধু ভাঙনের খেলা, স্বামী -স্ত্রী-র পরস্পরের মধ্যে চলে অবিশ্বাস আর স্বার্থপরতার যুদ্ধ, তখন তীর্থঙ্কর আর সুজাতার এমন – ভালোবাসাবাসি আমাদের কলুষিত সমাজে সুবাসিত বাতাস এনে দেয়। মেয়ে সুচেতনা এই অমল বাতাসের এক ফুলের নাম।

আজ তীর্থঙ্কর চন্দকে নিয়ে লিখতে বসে আমি তাঁর কর্মযজ্ঞ নিয়ে কিছুই বলছি না, কিংবা বলা যেতে পারে বলতে ইচ্ছে করছে না। তাঁর পাণ্ডিত্য – তাঁর লেখনীর ধার – তাঁর লেখা প্রবন্ধ, নাটকের ভাণ্ডার – এসব নিয়ে আলোচনা করবেন পণ্ডিতরা। করেও এসেছেন তাঁরা। তিনি কী পুরস্কারে ভূষিত, কত অনায়াসে খ্যাতির মিথ্যে – বিড়ম্বনা তিনি দু-হাতে ঠেলে সরিয়েছেন সেসব নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। ওই যে বললাম, এক সাধারণ অথচ অসাধারণ এই পরিবার তথা মানুষটিকে নিয়ে লিখতে বসলে উপন্যাস হয়ে যাবে। সীমিত শব্দবাঁধনে তাই আমি বরং তাঁর অনালোচিত মননকে স্পর্শ করে থাকি।

আমরা সবাই জানি তাঁর নাট্যচর্চার শুরু নান্দীকার-এ। বাবা-মা-এর আদর্শের কল্যাণে বাম রাজনীতির গঠনমূলক স্বচ্ছতায় তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা – তাই ষাট-সত্তর দশকের কমিউনিস্ট মতাদর্শে যখন ভাঙন ধরেছিল, কিছু সুবিধাবাদী বাম নেতা নিজেদের কমিউনিস্টপন্থীর মুখোশে ঢেকে সমাজের কিশোর – যুবকদের নিয়ে মিথ্যে- মিথ্যে খেলায় মেতেছিলেন – তীর্থঙ্কর চন্দ-এর অনুভবে আগুন জ্বলছিল। তাই আমরা দেখতে পাই ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’-র মতো নাটক – যে নাটক বার বার দেখেও ইচ্ছে হয় আবার দেখি। প্রথমবার নাটক শেষে যখন সিট ছেড়ে উঠতে পারিনি, দাদার কাছে ছুটে গিয়ে তাঁর বুকে পড়ে অঝোরে কেঁদেছি – এ কী দেখলাম – শুনলাম – উনি আমার মাথায় হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘শান্ত হও, শান্ত হও’। শান্ত হবো ? বুকটা খাঁ খাঁ করে জ্বলছিল নাকি পুড়ছিল ! এমন লেখা কার হাত দিয়ে বের হতে পারে?

বাবা-মা-এর দীর্ঘ রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত – তাঁদের জীবন-যাপনের দগদগে ঘা স্ত্রী সুজাতার নীরব যুদ্ধ – গনগনে আগুনের তাপে না পুড়লে এই লেখা আসতে পারে ? এতো স্বচ্ছ অথচ বলিষ্ঠ তাঁর এই লেখনী সমস্ত থিয়েটার জগতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাঁর প্রতিটি নাটক একে অপরের চেয়ে আলাদা – সেতুরাম, আরশি, বসন্ত আসছে, স্পন্দন, সামান্য ক্ষতি, সিকিউরিটি, গাধাবাজার, দীপদণ্ড, হন্যমান, ডাক, পরদেশী, হন্তারক – আরও কত কত বলবো। – থিয়েটার জগতের প্রায় প্রত্যেকটি দল তাঁর একটি নাটক পাওয়ার আশায় বসে থাকে। কেন ? কী আছে তাঁর লেখায় ? আছে মানুষের কথা – তাদের মান-হুঁশের কথা। সুন্দরম নাটক রচনা প্রতিযোগিতায় যখন প্রথম হলেন, থিয়েটার জগত পেয়ে গেল মাটি ছুঁয়ে থাকা সমাজ-সচেতক এক অন্যতম নাটককারকে। তাঁর নিজস্ব দলের নাম আবহমান হালিশহর। এই দলের খ্যাত অনেক প্রযোজনার মধ্যে ‘ভবঘুরে’ আর ‘অন্ধ খোঁড়ার গল্প’ চিনিয়ে দিয়েছিল তীর্থঙ্কর চন্দ শুধু একজন নাটককার প্রাবন্ধিক – সুবক্তা – প্রশিক্ষক – নির্দেশক নন, একজন জাত অভিনেতাও – সামান্য একটা ছড়ি ও টুপি হাতে ‘ভবঘুরে’ নাটকে তাঁর অসাধারণ – অভিনয় ভুলতে পারা যায় কী ?

আমি আমার ছেলেকে এগারো-বারো বছরে প্রথম আবহমান হালিশহরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও বেশ কয়েকটি দল একত্র হয়ে যে আয়োজন করে শিশু-কিশোর বিকাশ মেলা, সেখানে পাঠিয়েছিলাম। কেন জানেন ? আমাদের শহরের এই তথাকথিত ঝাঁ চকচকে চারদেওয়ালের বাইরে যে একটা মুক্ত বাতাস আছে থিয়েটার জগতের বা মানুষের, তা বুঝুক – ছোটবেলা থেকেই সেটা ও জানুক – যেন ও মাটি ছুঁয়ে বড় হতে পারে। সমাজের কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে শিখতে পারে। তীর্থঙ্কর চন্দ-এর এই শিশু-কিশোর নাট্যমেলার কর্মশালায় এই মননচর্চাই হয়। প্রতিটি ছেলেমেয়ে ওখানে প্রজাপতি হয়ে যায়। অথচ ওখানে বাসন মাজা থেকে শুরু করে উনুন জ্বালানোর জন্য কাঠকুঠো সংগ্রহ করতে হয়। ছেলেমেয়েগুলো এসব সব কাজই করে গান করতে করতে- কী যে মধুর পরিবেশ। এমন নয় যে যারা শেখান, তাঁরা দাদাগিরি করতে যান, তা নয় – তাঁরাও শিখতে যান – ছাত্র-মাস্টারমশাই ছোট বড়ো সবাই এক হয়ে নাট্যে – গানে – নানা রকম শিল্পে কত নতুন নতুন গভীর সব ভাবনার জন্ম দেন। এইতো সত্যিকারের নাট্য কর্মশালা, যেখানে জন্ম হয় নাটককার, অভিনেতার, শিল্পীর। ফেরার দিন একে অপরের হাতে মোমবাতি জ্বেলে সবাই গান গায়, কাঁদতে থাকে অঝোরে। এই তো থিয়েটার-যাপন। নাট্যজগতে এমন কর্মশালা আমি অন্তত দেখিনি। এমনটাই হওয়ার কথা – পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষাভাবনায় অনুপ্রাণিত তীর্থঙ্কর চন্দ তাঁর ভাই শুভঙ্করের সঙ্গে যৌথভাবে ফ্রেইরির বই ‘পেডাগজি অব্ দ্য অপ্রেসড’-এর অনুবাদ ‘নিপীড়িতের শিক্ষাবিজ্ঞান’ শুধুমাত্র লিখে ক্ষান্ত থাকেন নি, তাঁর জীবন-যাপনের কর্মকাণ্ডের শিরায় শিরায় এর ছাপ রেখে যাচ্ছেন। এখনও অক্লান্ত তাঁর লেখনীর ধার। আমরাও আছি আরো আরো আগুনের আশায়।

আরো কতকিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সীমিত শব্দবাঁধনে অতো বড়ো সূর্যটাকে কি ধরা যায় ? মনে হচ্ছে কিছুই তো বলা হলো না। বাকি রয়ে গেল অনেক কিছু – থাক, ধরা নাই পড়ুক এই লেখায় তাঁর কর্মযজ্ঞের ইতিহাস – দাদার লেখনীর ধারে বোনের চোখের জলে দাদার পাঞ্জাবী যখন ভিজে গিয়েছিল – তিনি বলেছিলেন, ‘স্নেহ বড়ো বিষমবস্তু’ – এই স্নেহের পরশটুকু শুধু ছোঁওয়া থাক আপাতত এই লেখায় – দাদা তীর্থঙ্কর চন্দ-এর কথাতেই লেখা শেষ করি – “মানুষ তো শুনেছি এভাবেই বেঁচে থাকেন মানুষের বুকের ভিতর – পরবর্তী সময়ের মানুষেরা এভাবেই তো পূর্বসূরীদের বহন করে নিয়ে যেতে থাকে, তাদের বাঁচার ভেতর দিয়ে বাঁচতে থাকেন তাঁরা – বেঁচে থাকেন’ —
প্রণাম দাদা।

2 thoughts on “অন্য মানুষ – তীর্থঙ্কর চন্দ | সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায়

  1. এই সুযোগে তীর্থ দাকে শারদীয়ার প্রণাম জানাই। সুচরিতা দি খুব ভালো লেখাটা হয়েছে।

Comments are closed.