টু ডেজ উইথ পিটার ব্রুক | কমল সাহা

চলে গেলেন পিটার ব্রুক। একটি মানুষ যাঁর কাছে আক্ষরিক অর্থে গোটা পৃথিবীটাই ছিল এক মঞ্চ। যিনি থিয়েটারকে নিয়ে গিয়েছিলেন পরিত্যক্ত কারখানায়, রাস্তার মোড়ে, জাহাজের ডকে। যাঁর স্পর্ধা ছিল ইংরেজি ভাষায়, ইংরেজি মঞ্চে ৯ ঘণ্টার মহাভারত পরিবেশনা করার আর “আর্য” পাণ্ডবদের চরিত্রে ব্রিটেনের কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের অভিনয় করানোর। গোটা দুনিয়া থেকে মুছে যাওয়া “শিল্পী” শ্রেণীর অন্যতম শেষ প্রতিভুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম। ৯৭ বছর বয়সে চলে গেলেন Peter Brook (২১ মার্চ, ১৯২৫ – ২জুলাই, ২০২২)। আমাদের স্মৃতিতে অমলিন রয়ে গেল এই মহান ইংলিশ থিয়েটার ও ফিল্ম ডিরেক্টরের অসামান্য থিয়েটার প্রযোজনা ‘দি মহাভারত’! এই মহান স্রষ্টা কে অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা।

এই সেদিন প্রয়াত হয়েছেন বিশ্বনন্দিত পরিচালক পিটার ব্রুক। তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। সামান্য একটু স্মৃতি সকলের কাছে নিবেদন করতে চাই ,তাঁর প্রতি আমার তর্পণ হিসেবে।
১৯৮৫ নন্দন প্রেক্ষাগৃহে পিটার ব্রুক পরিচালিত দীর্ঘ ন’ঘণ্টার ‘মহাভারত’ সিনেমা দেখি। এর কয়েকদিন বাদে একটি আমন্ত্রণ পত্র পাই। জানানো হয়, নির্বাচিত দর্শক আর থিয়েটার কর্মীদের সামনে স্বয়ং ব্রুক সাহেব ‘মহাভারত’ নির্মাণ বিষয়ে কথা বলবেন, সেই দু’দিনের আলোচনা সভায় আমিও একজন নির্বাচিত দর্শক, অথবা অতিথি ছিলাম । প্রধান উদ্যোক্তা ‘নান্দীকার’। মহা আনন্দে যোগদান করি । পিটার ব্রুক তাঁর কয়েকজন সহশিল্পী সহ প্রবেশ করেন। সহশিল্পীরা খুব শক্ত করে এ-ওর হাত ধরে রাখেন। তিনি বলেন: আমরা যদি পরস্পরের উষ্ণতা অনুভব না করতে পারি একসঙ্গে অভিনয় করব কীভাবে?
মহাভারত শুধু ভারতের মহাকাব্য নয়, সমগ্র পৃথিবীর জীবন্ত ইতিহাস। এই কারণে আমার ছবিতে বহু দেশের বহু শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন । আমি শিল্পী সংগ্রহ করেছি, স্টার আর্টিস্ট নিইনি । দ্রৌপদী হয়েছেন মল্লিকা সারাভাই; ভারতের নারীকেই নিয়েছি ওই মহাকাব্যের নায়িকা হিসেবে । সবাইকে তেমন মানায়নি কিন্তু এই পৃথিবী ও এই মহাকাব্য তো দেশকাল মান্য করে না ।
(সাদা চাদর বিছিয়ে থিয়েটারে SPACE- এর ব্যবহার দেখানো হয়)
আমি বিভিন্ন দেশের লোকনাট্য,পুরাণ এবং পুরাতত্ত্বের সন্ধান করেছি। ভারতে এসে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি । এবং বাংলার যাত্রাপালা শুনেছি, ছৌ নাচ দেখেছি। আমাকে এ-ব্যাপারে সাহায্য করেছেন প্রবীর গুহ…কোথায়, প্রবীর কোথায়?
‘অভিমন্যু বধ’ পর্বে আমি ছৌনাচের শারীরিক ভঙ্গির ব্যবহার করেছি।

পিটার ব্রুকের সঙ্গীত পরিচালকও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, খুব চিন্তায় ছিলাম, টাইটেল মিউজিক কী হবে ! শান্তিনিকেতনে গিয়ে যখন ওই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি শুনি তখন মনে হয় ,যা চাইছিলাম পেয়ে গেছি। গানের কথা অনুবাদ করিনি। ওই সুরের মধ্যেই এই মহাকাব্যের মর্মনির্যাস খুঁজে পেয়েছি। অন্তর মম বিকশত করো…এটাই তো বিশ্ববাণী!

পিটার ব্রুকের এই অনুষ্ঠান আদৌ কোনো ওয়ার্কশপ ছিল না। একটা বড় মাপের শিল্প কীভাবে তিনি গড়ে তুলেছিলেন, ছিল তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তিনি বারবার বলছিলেন: প্রচুর অর্থ, প্রচুর উপকরণ থিয়েটারের জন্য আবশ্যিক নয়। যেটা জরুরি তা হচ্ছে প্রবল ইচ্ছাশক্তি। যে কোনো স্থানে, যে কোনো পোশাকে একটা নাটক মঞ্চস্থ করা সম্ভব। পৃথিবীর সমস্ত কোণই একটা নাট্যশালা বা রঙ্গভূমি । অদম্য প্যাশন আর নিরন্তর অনুশীলন থাকলে থিয়েটার জীবন্ত হতে বাধ্য।

6 thoughts on “টু ডেজ উইথ পিটার ব্রুক | কমল সাহা

  1. ছোট্ট পরিসরে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানালো অমল আলো।
    ভাবতে ভালো লাগছে এমন একটি লেখা হাতে পেয়েছি আমরা।

  2. আরো অনুসন্ধান চলবে আমাদের পিটার ব্রুক নিয়ে। ধন্যবাদ কমল দা।

Comments are closed.