বাংলা থিয়েটারে উৎপল দত্তের মত দক্ষ শক্তিশালী অভিনেতা হাতে গোণা। অভিনয়ের যে কোন মাধ্যমেই তিনি নিজেকে যুক্ত করেছেন, সেখানেই অনন্য হয়ে উঠেছেন। তার একটাই কারণ, থিয়েটারকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন অন্তরের সঙ্গে। এছাড়া অভিনয়চর্চার পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব পড়াশুনোর শিকড় ছিল অনেক গভীরে। যে কোন পার্ফমিং আর্ট এর সঙ্গে যদি স্বকীয়তা, শিক্ষা, নিজস্ব ভাবনার স্বাতন্ত্র্য যুক্ত হয়, তবে সেই শিল্প যথার্থই নান্দনিক হয়ে ওঠে। তাই শুধু থিয়েটার নয়, চলচ্চিত্র এবং যাত্রাশিল্পেও উৎপল দত্ত হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য।বরং বলা ভাল,অভিনয়ের সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে উৎপল দত্তের মত অভিনেতা পথনাটকও করেছেন। এই সবকিছুর মধ্যেই তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা এবং অভিনয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রমাণিত। চলচ্চিত্র এবং যাত্রায় তিনি নিজেকে যুক্ত করলেও থিয়েটারই তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্র ছিল, এমন মনে করাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না।
নিজে অজস্র নাটক লিখেছেন। তার মধ্যে অনেক নাটকই তাঁর রাজনৈতিক চেতনা থেকে লেখা। দেশ বিদেশের রাজনীতি এবং থিয়েটার দুই বিষয়েই তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। এই পাণ্ডিত্য তিনি অর্জন করেছিলেন। প্রতিনিয়ত সমসাময়িক রাজনৈতিক চেতনা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন, আলোড়িত হয়েছেন – আর সে সবের প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর থিয়েটারে। অবশ্য প্রতিফলন ঘটেছিল না বলে প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন বলাটা বেশি যুক্তিসঙ্গত।কারণ থিয়েটারকে তিনি সমাজের প্রতি ও মানুষের প্রতি একটি দায়বদ্ধ মাধ্যম বলে মনে করতেন।
নিজে যেমন থিয়েটারের মঞ্চে একজন দক্ষ অভিনেতা, তেমনই একজন দায়বদ্ধ নাট্যকারও তিনি। আর থিয়েটারের নির্দেশক হিসাবে তিনি কতখানি দক্ষ তার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন তাঁর পরিচালিত অজস্র থিয়েটারে।
নিজের লেখা অনেক নাটক তিনি নিজে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন। হয়তো নিজের মত করে নাটক করার জন্য অথবা নাটকে নিজের ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য তিনি নাটক লেখায় ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর অধিকাংশ নাটকে সমকালীন রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছে, এ কথা ষোল আনা সত্য। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক উৎপল দত্ত এবং নাট্যকার উৎপল দত্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
যদিও রাজনৈতিক থিয়েটার ব্যাপারটা বাংলা থিয়েটারে সাধারণ রঙ্গালয় পর্ব থেকেই চলে আসছে। “নীলদর্পণ” নাটক তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে “নীলদর্পণ” এর রাজনৈতিক ভাবনা আর উৎপল দত্তের নাটকে রাজনৈতিক ভাবনার তারতম্য তো আছেই। দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ” ছাড়াও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হরলাল রায়, উপেন্দ্রনাথ দাস, উমেশচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নাটক লিখেছিলেন। তারও পরে গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, এমন কি রবীন্দ্রনাথের নাটকেও সেই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু উৎপল দত্ত তাঁদের থেকে অনন্য হয়ে উঠেছেন। কারণ দীনবন্ধু থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল হয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যে নাটক তাতে রাজনীতিই প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি ছিল না। কিন্তু উৎপল দত্তের নাটকে বা থিয়েটারে রাজনীতি অনেক বেশি গুরুত্ব ও প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির নাট্যকার।শাসক এবং শোষকের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণানোর ক্ষেত্রে নাট্যকার উৎপল দত্ত অনেক বেশি সাহসী। অনেক সরাসরি তিনি নাটকে রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
অভিনয়ের সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে যুক্ত করেছেন।তবু বলতেই হয়, থিয়েটারই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। এবং সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক থিয়েটার। নিজে অনেক নাটক লিখেছেন। নাটক লিখেছেন রাজনীতির তাগিদেই।নিজের রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলনের পাশাপাশি দেশ বিদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নিজের লেখা নাটকে। একজন নির্দেশক হিসাবেও তিনি স্বকীয়। বলা ভাল পুরোপুরি উৎপলীয়। যদি যাত্রার দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে উৎপল দত্ত যে সব যাত্রাপালা লিখেছিলেন, সেখানেও তিনি রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন, যাত্রা অভিনয়ের আঙ্গিক যাতে অনেক বেশি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে। রাইফেল, জালিয়ানওয়ালাবাগ, নীল রক্ত, দিল্লী চলো, সন্ন্যাসীর তরবারি, বৈশাখী মেঘ, সীমান্ত, অরণের ঘুম ভাঙছে, সাদা পোশাক, দামামা ঐ বাজে প্রভৃতি নিজের লেখা যাত্রাপালায় তিনি তাঁর নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। এইসব যাত্রাপালার নির্দেশকও ছিলেন তিনি নিজে। প্রায় সব পালাগুলিই শহর,গ্রাম,গঞ্জে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নিউ আর্য অপেরা, সত্যম্বর অপেরা, ভারতী অপেরা, লোকনাট্য, তরুণ অপেরা, নবরঞ্জন অপেরা প্রভৃতি যাত্রাদলে এইসব যাত্রাপালা অভিনীত হয়েছিল রাতের পর রাত।
উৎপল দত্ত বাংলা থিয়েটারে শুধু নয়, অভিনয়ের জগতে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এমন এক অভিনেতাকে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকরা নিছক একজন ভাঁড় বা কুচক্রী চরিত্রের অভিনেতা হিসাবে চিনেছিলেন। অথচ এই উৎপল দত্তই লাল দুর্গ, জনতার আফিম, লেনিনের ডাক, দিন বদলের পালা, টিনের তলোয়ার, তিতুমীর, ব্যারিকেড, দু:স্বপ্নের নগরী, ঘুম নেই, ফেরারী ফৌজ, কল্লোল প্রভৃতি নাটকের নাট্যকার।
৬৪ বছরের একটি জীবন ফুরিয়ে গেছে ১৯৯৩ সালের ২৯ আগস্ট। কিন্তু তার পর থেকে এ পর্যন্ত না থেকেও বাংলা থিয়েটারে জড়িয়ে আছেন। তাই ব্যারিকেড, তিতুমীর, টিনের তলোয়ার, জালিয়ানওয়ালাবাগ নাটকগুলি এখনও বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে তুফান তুলছে। জোর গলাতেই বলা যায়, আর একজন রবীন্দ্রনাথ যেমন হয়তো আর আসবে না, তেমনই উৎপল দত্তের মত আর একজন অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক, পালাকার, অভিনেতাও হয়তো আর আসবে না।