তাঁর জন্মদিনে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচুর স্মরণসভা দেখতে পেয়েছি, মৃত্যুদিনেও তাই। নানাজনে নানা ভাবে তাঁকে স্মরণ করছেন। প্রশ্ন হল, স্মরণ করা আর অনুসরণ করা এক কথা নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতা বিশ্ব বিখ্যাত। ২৫শে বৈশাখ বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাকুর পূজা হয়। ফুল বেলপাতা ধূপধুনো চন্দন উপচে পড়ে। এদের পঁচানব্বই শতাংশ রবীন্দ্রনাথকে পড়েনি। গ্রহণ করা দূরের ব্যাপার। এখন তো আবার রবীন্দ্র বর্জন গর্জন করছে।
উৎপল দত্ত যখন বেঁচে ছিলেন, নিজের কাজে সক্রিয় ছিলেন, তখন এলিট বাঙালি তাঁকে বিন্দুমাত্র আমল দিত না। আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতির মত প্রিন্ট মিডিয়া বহু সময় তাঁকে বর্জন করেছেন, গালাগাল দিয়েছেন। এলিট বাঙালি উত্তমকুমারকেও স্বীকৃতি দেয়নি। বুদ্ধিজীবীদের আড্ডাতে উত্তমকুমার ব্রাত্য ছিলেন। উৎপল দত্ত ছিলেন মহাত্রাস।
থিয়েটারের জগত দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিল। শম্ভু মিত্রকে কেন্দ্র করে যে অংশটা ছিল তাঁদের প্রমোট করত … বাজার পত্রিকা। উৎপল দত্তের নাটক অতি নিকৃষ্ট ধরনের, যার কোন শিল্পমূল্য থাকতে পারে না এই ছিল এলিট বাঙালির অভিমত! উৎপল দত্ত নাটক লিখতে পারেন না! তিনি নাটকের নামে যাত্রাপালা লেখেন! তাঁর পরিচালিত নাটক গুলো অতি নাটকীয়তা পূর্ণ জগাখিচুড়ী ব্যাপার!
বামপন্থীদের মধ্যে একটা অংশ ছিল যাঁরা এই প্রচারে সহমত পোষণ করতেন। সুধী প্রধান ছিলেন এঁদের নাটের গুরু। অতি বাম নকশালপন্থীরাও উৎপল দত্তকে সহ্য করতেন না। শিল্পের বিচার ইত্যাদির মধ্যে না ঢুকে তারা তাদের রাজনৈতিক লাইনের দিক থেকে আক্রমণ করতেন । এমন কথাবার্তা বলত, তিনি নাকি ছদ্দবেশী সি আই এর দালাল। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে অনেক লেখা, আলোচনা সভাতে তাঁকে নস্যাৎ করার জন্য ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হতো। প্রশ্ন তোলা হতো, তুমি যদি গণশিল্পী হও,তাহলে হিন্দি সিনেমাতে ভিলেন এর রোল কেন কর ? এরা সলিল চৌধুরীকে ঠিক এইভাবেই আক্রমণ করত! সলিল চৌধুরী যদি গণশিল্পী হন তাহলে হিন্দি সিনেমাতে সংগীত পরিচালনা করেন কেন? তিনি নাকি টাকার জন্য বম্বে গিয়ে ছিলেন!
বামপন্থীদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছিল যে, তুমি যদি গণ সংগীত গাও, গণনাট্য করো তাহলে তোমাকে চিরকাল কূপমন্ডুক হয়ে থাকতে হবে। তোমার যত বড় প্রতিভা থাকুক না কেন,সেই প্রতিভার জোরে তুমি আরো অনেক বড় কাজ করতে পারবে না। তোমার প্রতিভার বিনিময় তুমি রোজগার করতে পারবে না। তোমাকে না খেয়ে মরে গিয়ে শহীদ হয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, তুমি গণশিল্পী ছিলে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো শিল্পীও বুঝতে চাইতেন না যে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য নিজের গান বিক্রি করাটা অপরাধ নয়। পল রবসন তিনি তো গান বিক্রি করে খেতেন। কার্ল মার্কস পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছিলেন, টাকার জন্য লেখালেখি কোরোনা। তবে লেখা ছাপিয়ে বিনিময়ে পারিশ্রমিক অর্জন করবে।
শম্ভু মিত্র চল্লিশের দশকে পেশাদার অভিনেতা ছিলেন। কিছুদিন শিশির ভাদুড়ীর থিয়েটারে কাজ করেছেন। যেকোনো কারণেই হোক তিনি গণনাট্য এসে ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, গণনাট্য বর্জন করে বহুরূপী তৈরি করেছিলেন। তিনি যে, কথাটা প্রচার করতেন যা কিনা পরে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে গৃহীত হয়েছিল সেটা হলো, গ্রুপ থিয়েটার চর্চা নাকি মাইনোরিটি কালচারের বিষয়। এই থিয়েটার দিয়ে যেমন বাণিজ্য করা যাবে না, অনুরূপভাবে এই থিয়েটার সমাজের সর্বস্তরের দর্শক আকর্ষণ করা যাবে না। অর্থাৎ শুধুমাত্র এলিট শ্রেণীর কালচার হিসেবে এটাকে ব্যবহার করতে হবে। দেখা গেছে, তাঁর দর্শক হতো না। বাদল সরকার লিখছেন, আমরা জানতাম শম্ভুদা যখন নিউ এম্পায়ারে রবিবার সকালে নাটক করেন তখন তিনতলার এক টাকার টিকিটটা পাঁচ মিনিট আগে গেলেও পাওয়া সম্ভব। শম্ভুবাবু মিনার্ভা থিয়েটার হলে নাটক করতে এসে চূড়ান্ত ফেল করেছিলেন। সেটা ষাটের দশক ছিল। পরে অবশ্য আশির দশকে তাঁর বৃদ্ধ বয়স, তাঁর নাটক দেখার জন্য লোকজন আসত। তাঁর একটা সুবিধা ছিল, বাজার পত্রিকাগুলো বিপুলভাবে যে শম্ভুবাবুকে প্রমোট করত। এমনও বলা হত, তিনি নাকি স্যার লরেন্স অলিভিয়ার এর থেকেও অনেক বড় অভিনেতা ছিলেন!
উৎপল দত্তের কপাল ছিল মন্দ। তাঁকে বারবার গুন্ডা পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। জেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁর থিয়েটার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব অশ্লীল অভিযোগ প্রচার করা হয়েছে। তবুও তাঁর থিয়েটারে দর্শকের কখনো ঘাটতি দেখা যায়নি। তাঁর দলের অভিনেতারা বলতেন, যখন অভিনয় করি, সামনে দশ হাজার দর্শক না পেলে অভিনয়টা খোলে না।
তিনি ইংরেজি, জার্মান, রুশ, ফ্রেঞ্চ, উর্দু, হিন্দি, অসমীয়া, ভোজপুরি, ভাষায় দক্ষ ছিলেন। সত্যজিৎ রায় এই কারণেই আগন্তুক ছবিতে উৎপল দত্ত কে নির্বাচন করেছিলেন। শুটিংয়ের সময় সত্যজিৎবাবু উৎপল দত্ত কে বলেছিলেন, চরিত্রটা নাকি তাঁর। সত্যজিৎবাবু, বিদেশে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ভারতীয় থিয়েটার বিষয়ে কথা উঠলে বলতেন, উৎপল দত্তের থিয়েটার ভারতের অন্যতম থিয়েটার।
পৃথিবীতে যাদের শেক্সপিয়ার, ব্রেখট, বিশেষজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাঁদের মধ্যে উৎপল দত্তের স্থান অন্যতম। ভারতীয় থিয়েটার ব্যক্তিত্বদের মধ্যে, উৎপল দত্তর সমকক্ষ দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে না একথা স্বীকার করতে আজও অনেকে হোঁচট খান। উপায় নেই একথা স্বীকার করার, কারণ, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র থিয়েটারের ইউনিভার্সিটিতে উৎপল দত্তের থিয়েটার পড়ানো হয়। ইউরোপ আমেরিকাতে এমনকি লাতিন আমেরিকাতে উৎপল দত্ত চর্চা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটা না জানলে মূর্খের স্বর্গে বাস করতে হবে।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যাত্রার মত করে নাটক লেখেন কেন?
তিনি হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ এঁরাও তো যাত্রার মতো করেই নাটক লিখে গেছেন।
তিনি বলতেন, নাটক হলো সেই বস্তু চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রের, চরিত্রের সঙ্গে সমাজের এবং রাষ্ট্রের এক জটিল দ্বন্দ্বের বিচিত্র সমাহার!
তিনি ক্লাসিক নাটকে অতিরিক্ত অনুরাগ দেখাতেন। মিহিন মধ্যবিত্তের ড্রইংরুম ড্রামা তাঁর ছিল দুচোখের বিষ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত বলতেন, “মধ্যবিত্তের জীবনে না আছে গল্প, না আছে নাটক। নাটক হল সেই জিনিস–বড় বড় সাম্রাজ্যের উত্থান পতন! বিরাট বিরাট মানুষের বিরাট বিরাট আবেগ, দ্বন্দ্ব, ঘনীভূত সংকটের জটিল কাব্য! খাটো খাটো মানুষের চরিত্র করে নাটক হয় না”! তিনি দ্বান্দ্বিক অভিনয় বিশ্বাসী ছিলেন। ইমোশনাল অ্যাক্টিং বর্জন করতেন। একজন অভিনেতাকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের রহস্য জানতে হবে। এটাই ছিল তাঁর দাবি।
তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ছিল, তিনি শ্রেণী-সংগ্রামের প্রচারক। হাসতে- হাসতে বলতেন, পৃথিবীতে এমন একজন কবি, নাট্যকার দেখাও দেখি যে তাঁর নিজের দর্শণের প্রচারক নন? রামায়ণ মহাভারত যাঁরা রচনা করেছেন তাঁরাও তো কিছু প্রচার করতে চেয়েছিলেন! আর্য অনার্যদের সংঘর্ষের যে যুগ, জমি দখলের — অর্থাৎ শ্রেণীসংগ্রামের জটিল অধ্যায়কে সামনে রেখে, বহিরাগত আর্যদের প্রাধান্য ও মহিমা প্রচার করার জন্য ওই দুটি মহাকাব্য রচিত হয়েছিল!
আজ যখন আমরা স্মরণ করি তাঁকে, তখন মানুষটাকে ভেতর থেকে বুঝতে হবে। কেন তিনি স্মরণীয়? রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবীন্দ্রনাথের দুটো গান দুটো কবিতা গলায় তুললে রবীন্দ্রনাথকে কি বোঝা যায়? ওটাতো নিছক ছেলেমানুষি! বাঙালি যেমন রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো গ্রহণ করল না, একইভাবে উৎপল দত্ত যখন বেঁচে ছিলেন, তখন দুই একটি দল ছাড়া কলকাতার তাবড় -তাবড় দলগুলো উৎপল দত্ত কে গ্রহণ করেন নি। তাতে উৎপল দত্তের ক্ষতি কিছু হয়নি। ক্ষতি হয়েছে বাংলা থিয়েটারের। অবশ্যই এটা বলতে হবে, রবীন্দ্র নাটক প্রযোজনা করার মত, উৎপল দত্তের নাটক প্রযোজনা করা খুব কঠিন কাজ। পরিচালকের দুর্বলতা ধরা পড়ে যায়। কিশোরকুমারের গানের হাজার হাজার কণ্ঠ বাজারে ঘুরে বেড়ায়। হেমন্ত, মান্না দের গান গাওয়া অত কি সহজ?
আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যেত যে, বাজার পত্রিকা নিয়ন্ত্রিত একটা গোষ্ঠী ছিল যারা বাংলা সংস্কৃতির উপর লাঠি ঘোরাত। তারা ঠিক করে দিত কে কবি, কে শিল্পী, কে সাহিত্যিক। এই গোষ্ঠী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে কোনদিন মর্যাদা দেয়নি। ওরা প্রচার করত , শরৎ সাহিত্য বটতলার সাহিত্য। অলস গৃহিণীদের দুপুরবেলার দিবানিদ্রার সহায়ক শরৎচন্দ্র। এই গোষ্ঠীর বাইরে হাতেগোনা কয়েকজন বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন যাঁরা শরৎ সাহিত্যের মূল্য নির্ধারণ করেছেন।
একইভাবে সেই সময়, কলকাতার থিয়েটার মহলের অনেক ব্যক্তি আগ্রহ নিয়ে উৎপল দত্তের নাটক দেখতে আসতেন। নিজেদের মহলে উৎপল দত্তের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রশংসা করতেন । প্রকাশ্যে নীরব থাকতেন। এরা বুঝতে পারতেন, উৎপল দত্তের নাটক নিয়ে প্রোডাকশন সাজালে ব্যবসায়িক সফলতা আসবে না। প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। বাজার পত্রিকাগুলো তাদের ধোপা নাপিত বলে বন্ধ করে দিতে পারে।
মিনার্ভায় — অঙ্গার / মানুষের অধিকারে /কল্লোল / তিতাস একটি নদীর নাম এইসব নাটক দেখবার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদগ্ধজনেরা আসতেন! ফেরারী ফৌজ নাটক ভূপেন দত্ত দেখতে এসে বলেছিলেন, এটাতো আমাদের জীবনের কথা! পি এল টি পর্বে আমরা দেখেছি, রবীন্দ্র সদন, একাডেমি, কলকাতার যেকোনো হলে অভিনয় থাকলে মফস্বল শহরের থিয়েটার পাগল মানুষেরা দলে দলে এসে ভিড় করত। যেন তারা নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিতে এসেছে।
উৎপল দত্তকে স্মরণ করতে গিয়ে মনে রাখতে হবে, ওই মানুষটার পথ ছাড়া আপাতত অন্য কোন পথে মানুষের বা জীবনের থিয়েটার নির্মাণ করা যাবে না। থিয়েটারের প্রথম শর্ত হলো, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। শ্রেণী সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার থিয়েটার। মধ্য ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত জেলার থিয়েটারগুলো অন্তর থেকে বিশ্বাস করত, পালন করত। তারপর শুরু হয়ে গেল অবক্ষয়। বিগত পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,গত কুড়ি বছরের বাংলা নাট্য মঞ্চে দুই একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে আর কোন উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা পাওয়া গেল না। কারণ, থিয়েটারের রাজনীতিতে যে আবর্জনা ঢুকে পড়েছে। উৎপল দত্ত বলতেন, যে থিয়েটারের রাজনীতি ভুল, সেই থিয়েটারটা ভুল। শাসকের বদান্যতায় ঠিক থিয়েটার নির্মাণ করা যায় না।